প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৪ জুলাই, ২০২১ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারীতে হজ্ব নিয়ে ভাবনা

বিশ্বের বুকে করোনা মহামারী চলমান। তার প্রভাব এসে পড়ে হজ্বের ক্ষেত্রেও। যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ নর-নারী প্রতি বছর হজ্ব করে থাকেন, সেখানে ২০২০ সালে সৌদিতে অবস্থানরত মাত্র ৯৩৭ জন নর-নারী হজ্ব করার সৌভাগ্যবান।
গত ১২ জুন সৌদি আরবের হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় জানা যায় চলতি ২০২১ সালের হজ্বেও গত বছরের মত বিদেশি কোন হজ্বযাত্রী আসবে না। সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে সৌদি নাগরিক ও বৈধ প্রবাসী মিলে ৬০ হাজার জনকে হজ্বের জন্য বাছাই করা হবে। যাদের বয়স হবে ১৮ থেকে ৬৫ বছর ও সুস্থ শরীরের অধিকারী হতে হবে। করোনা টিকা নেয়া থাকতে হবে। যারা গত ৫ বছর হজ্ব করে নাই তারা অগ্রাধিকার পাবে। তবে সৌদি সরকার গত বছরের মত ১০ হাজার জন তালিকাভুক্ত করে তৎমধ্যে ১ হাজার জনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৯ শত ৩৭ জন হজ্ব করে। এখানে কি ৬০ হাজার জন তালিকাভুক্ত হবে, না হজ্ব করবে তা অস্পষ্ট; সময় বলে দিবে। হজ্বের ইতিহাসে এ রকম প্রতিকূলতা বারেবারে হয়েছিল।
হজ্ব আদি যুগ থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। নবী রাসূলগণ মূলকে শাম থেকে পবিত্র মক্কায় আসতেন হজ্ব করতে, আবার ফিরেও যেতেন। নবী পাক (স.)’র নবুওয়্যাত প্রাপ্তির আগে বুঝ হবার পর থেকে মনে হয় হজ্ব বাদ দেন নিই। হজ্বের প্রধান আহকাম আরাফাতে অবস্থান। সে সময় কুরাইশরা না বুঝে মুজদালফাকে আরাফাত হিসেবে গণ্য করে থাকত। ফলে সমস্ত হাজী মুজদালফায় জমায়েত হত। কিন্তু নবী পাক (স.) প্রকৃত আরাফাতে গিয়ে একা অবস্থান নেন। এক পবিত্র মক্কাবাসীর উট হারিয়ে যায়। ঐ দিন ঐ ব্যক্তি উট তালাশ করতে করতে আরাফাতে গমন করে। দেখতে পেলেন নবী পাক (স.)’র একা আরাফাতে অবস্থান তথা ওকুফ করতেছেন।
পবিত্র মক্কা মোকাররমা বিজয়ের পরের বছর নবম হিজরিতে নবী পাক (স.)’র নির্দেশে প্রায় ৩ শ’জন সাহাবী পবিত্র মদিনা থেকে হযরত আবু বকর (র.)’র নেতৃত্বে হজ্ব উপলক্ষে পবিত্র মক্কায় যায়। ওনাদের মধ্যে হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (র.), হযরত আবদুর রহমান ইবনে অউফ (র.) ও হযরত আবু হুরায়রা (র.) সহ বিশিষ্ট সাহাবীগণও ছিলেন। এর মধ্যে সূরা তওবার আয়াত নাযিল হয়। এতে অমুসলিমের জন্য পরের বছর থেকে মসজিদুল হারমে আসা তথা হজ্ব নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে হযরত আলী (ক.)’র নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ নবী পাক (স.) প্রেরণ করেন। তিনি হযরত আবু বকর (র.)’র সাথে মিলিত হয়ে হজ্বে গমন করেন। এবং ঘোষণা দেন আগামী বছর থেকে অমুসলিমদের জন্য কোন হজ্ব নেই। অর্থাৎ কোন অমুসলিম আগামী বছর থেকে হজ্বে আসা যাবে না।
অতঃপর দশম হিজরিতে নবী পাক (স.) মদিনা মুনাওয়ারা থেকে স্বয়ং হজ্ব করতে যান। মদিনা মুনাওয়ারা হতে রওনা দিয়ে জুল হুলায়ফা মিকাতে অবস্থান নেন। গোসল করেন, এহরাম পরিধান করেন। তাঁর নবুওয়্যাত জিন্দেগীতে ইহা বিদায় হজ্ব বলা হয়। এ সময় জজিরাতুল আরবে মহান সাহাবাগণের বাঁধ ভাঙ্গা ঢল নামে হজ্ব উপলক্ষে। এ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজীরা মক্কা মোকাররমায় এসে একত্রিত হয়। অনেকে মিনায় এসে একত্রিত হয়। বিভিন্ন বর্ণনায় নবী পাক (স.)’র সাথে সোয়া লক্ষ নর-নারী হজ্ব করেন বলে জানা যায়। আরাফাতের ময়দানে উম্মতের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন নবী পাক (স.), যা বিদায় হজ্বের ভাষণ হিসেবে খ্যাত। এতে রয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য দিক নির্দেশনা।
পরবর্তীতে হজ্ব মহান খলিফাগণের নেতৃত্বে জারি থাকে। তবে সংখ্যায় ১৯ শতকের মত ব্যাপক ছিল না। তার মূলে যোগাযোগ প্রতিকূলতা। পবিত্র কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফে ওমরাহর কথা থাকলেও যাতায়াত প্রতিকূলতায় হজ্ব করা যেখানে কষ্টসাধ্য সেখানে ওমরাহর কথা তেমন আসছে না। ফলে পবিত্র মক্কা ও তার নিকট এলাকার লোকজনই ওমরাহ করতেন।
হিজরির শুরু থেকে হজ্বের সমাগম হত জজিরাতুল আরব, মূলকে শাম ও মিশর কেন্দ্রিক। যেহেতু সড়কপথে দূরযাত্রায় উটের মাধ্যমে কত হাজার লোকইবা হজ্ব করতে যেত। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ভারতবর্ষের হাজীরা সোরাত বন্দর দিয়ে পাল তোলা ছোট ছোট জাহাজে ঝুঁকি নিয়ে হজ্বে যেত। যেহেতু সড়কপথে আফগানিস্তান, ইরানের দিকে নিরাপত্তার অভাব থাকত প্রায়ই।
হজ্বযাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক ছিল তুর্কি সুলতান ২য় আবদুল হামিদের আমলে দামেস্ক থেকে মদিনা মুনাওয়ারা ১৪৬৪ কি.মি রেল লাইন নির্মাণ। ইস্তাম্বুল থেকে বাগদাদ পর্যন্ত রেল সার্ভিস আগে চালু ছিল।
মূলকে শাম থেকে হজ্বে আসতে বড় জংশন হল দামেস্ক। এ দামেস্ক থেকে মদিনা মুনাওয়ারা পৌঁছতে উটে বা পায়ে হেঁটে ৪০ দিন সময় লাগত। পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কা আসতে ১৩ মঞ্জিল ১৩ দিন সময় লাগত। এতে সহজেই অনুমেয় যে, পবিত্র মক্কায় অনেকটা নিকটবর্তী জজিরাতুল আরবের লোকদের তত সময় লাগত না।
সুলতান ২য় আবদুল হামিদের শাসন আমলের শেষের দিকে ১৪৬৪ কি.মি দামেস্ক থেকে পবিত্র মদিনা রেল লাইন নির্মাণে আর্থিক সমস্যায় পড়ে। এতে ভারতবর্ষের ধনীরা, নবাবেরা অকাতরে খোলা মনে অর্থ প্রেরণ করেন। কিন্তু মাত্র ক’বছরের ব্যবধানে রাজনৈতিক কারণে এ রেল লাইন ধ্বংস হয়ে যায়। আজও মদিনা মুনাওয়ারা রওজা পাকের ১ কি.মি পশ্চিম পার্শ্বে রেল স্টেশনের দালান দৃশ্যমান রয়েছে।
হজ্ব ইতিহাসে সময়ে সময়ে চরম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিল। মহামারী, রাজনৈতিক গোলযোগসহ নানাবিধ কারণে হজ্ব বারে বারে বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন বর্ণনায় ৪০ বার হজ্ব বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা যায়। তবে বিগত ১৩৭ বছরের ব্যবধানে বর্তমান করোনা মহামারীর মত হজ্বের ক্ষেত্রে এ রকম প্রতিকূলতা আসে নাই। এ আধুনিক যুগে উন্নত যোগাযোগ অবস্থায় প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ লোক হজ্ব করছে গত ১০ বছর যাবৎ সৌদি সরকার হজ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতেছে বলে। তার আগে প্রায় ২০/৩০ বছর যাবৎ প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ বা কম বেশি নর-নারী হজ্ব করত।
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা অনুপাতে হাজারে একজন হজ্ব করতে পারে। সৌদি আরবের আভ্যন্তরীণ নর-নারী ৫ বছরে একবার হজ্ব করতে পারবে। সৌদি আরবে অবস্থানরত বহির্বিশ্বের মুসলমানগণের ক্ষেত্রেও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। মোয়াল্লেমের মাধ্যমে হজ্ব করতে হবে। এমনকি মক্কা মোকাররমার স্থায়ী বাসিন্দারাও নিয়ম নীতি তওয়াক্কা না করে হজ্বের সময় মিনা আরাফাতে গমন করতে পারবে না। এত আইন, নিয়ম নীতির পরেও ২০১৯ সালে ২০ লক্ষের মত নর-নারী হজ্ব করেন।
ওমরাহর ক্ষেত্রে কঠোরতা না থাকায় মক্কা মোকাররমায় সমাগম বেড়ে যায়। রমজান মাসে এ সমাগম হজ্বকে ছাড়িয়ে যায়। রমজানের শেষ দশকে পবিত্র মসজিদুল হারমের চারদিকে প্রায় ১ কি.মি অধিক এরিয়া নিয়ে ৩০/৪০ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। ইফতার, তারাবী, কিয়ামুল লাইলে এতে বিশাল সংখ্যক নর-নারী অংশ নিয়ে ইবাদতে থাকতেন। করোনা মহামারী বিস্তার লাভ করায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে সৌদি সরকার ওমরাহ আগমন বন্ধ করে দেয়। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে শত শত ওমরাহ যাত্রী আটকা পড়ে, অনেকে এহরাম পরিধান অবস্থায় ছিল।
করোনা মহামারীর প্রাথমিক অবস্থায় বিশ্বের জনগণের মাঝে আতংক সৃষ্টি হয়। এতে যেমনি আমাদের দেশে তেমনি সৌদি আরবে। ফলে মসজিদে হারম ও মসজিদে নববীতে ইমাম, মুয়াজ্জিন, স্টাফসহ ২/৩ শত নামাজী নিয়ে ৫ ওয়াক্ত জামাত ও জুমা হত। পরবর্তীতে নানান নিয়ম নীতির মাধ্যমে অতী সীমিত সংখ্যক লোক ওমরাহ করতে পারতেছে। এতে বুঝা যায় নফল তাওয়াফের সুযোগ নেই। মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও নিয়ম নীতি মেনে সীমিত সংখ্যক লোকজনই আসতে পারতেছেন।
গত বছর ২০২০ সালে সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশসহ বিদেশিরা হজ্ব করার অনুমতি পায়। সৌদি আরবে অবস্থানরত ১০ হাজার নর-নারী হজ্বের তালিকাভুক্ত হয়। তৎমধ্যে ১ হাজার জন চূড়ান্ত তালিকায়। এতে ৩ শত জন সৌদির এবং ৭ শত জন সৌদি আরবে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিক। কিন্তু বাস্তবতা নিরীখে হজ্ব করে ৯ শত ৩৭ জন।
যেখানে দুই পবিত্র নগরীতে সব সময় লাখ লাখ নর-নারী অবস্থান নিয়ে তাওয়াফ, নামাজ, ইবাদত বন্দেগীতে থাকত সেখানে আজ পবিত্র নগরী স্থানীয় কিছু লোকজন বাদে অনেকটা জনমানব শূন্য বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থানের তুলনায় ইবাদতকারীর আগমন শতে ৫ জনও নেই বললেই চলে।
বিশ্বে ১৩০ কোটির অধিক মুসলমান নর-নারীর দৃষ্টি দুই পবিত্র নগরীর দিকে। কবে এ করোনা মহামারী উঠে যাবে, কবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মুসলমান নর-নারীরা দুই পবিত্র নগরীতে আসতে পারবে তা মহান আল্লাহ পাকই জানেন।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করুন। করোনা মহামারী উঠিয়ে নিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ উম্মতে মুহাম্মদী যাতে দুই পবিত্র নগরীতে গমন করতে পারে আমাদের সে সুযোগ করে দিন। আমিন॥

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘প্রত্যেক বিচ্ছেদে মৃত্যুর ছায়া থাকে’
পরবর্তী নিবন্ধবিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নদের শপথ