প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৯ মার্চ, ২০২২ at ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

শিয়াদের সাথে আমাদের পার্থক্য
বিশ্বে প্রায় ১৯০ কোটি মুসলমানের মধ্যে প্রায় ১২-১৭ কোটির কম বেশি শিয়া মতালম্বী রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশে শিয়াদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের কম বেশি হতে পারে।
বিশ্বে আলোচিত দেশ ইরানকে শিয়াদের দুর্গ বলা হয়। বাস্তবেও প্রায় ৭ কোটি জনগণের দেশ ইরানের প্রায় সকলেই শিয়া। সীমান্তে স্বল্প সংখ্যক সুন্নি রয়েছে। ঐদিকে না গেলে ইরানে সুন্নিদের দেখামেলা ভার।
আমার পর পর ৩ বার ইরান সফর করার সুযোগ হয়। এতে আমার ভিতর কৌতুহল জাগে আমাদের সুন্নিদের সাথে শিয়াদের মৌলিক কি পার্থক্য রয়েছে তা বুঝার। যৌবনকাল থেকে শিয়াদের বিষয়ে অনেক কিছু শুনে আসতেছি। বাস্তবতা কি কতুটুকু।
১ম বার ইরান সফরে সহযাত্রী শাখাওয়াত হোসাইনের ইরানী ব্যবসায়ীর অফিসে আমি শিয়াদের আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করি। এতে একজন হামিদ কাবেরী আমার আগ্রহকে গুরুত্ব দিলেন। আমাকে নিয়ে কোম যাবেন বললেন। সেই মতে প্রোগ্রাম করে একদিন আমরা ২ জনকে তেহরানের হোটেল থেকে উঠিয়ে নিয়ে ১৬০ কি.মি দূরত্বে কোমের উদ্দেশ্যে রওনা হয় হামিদ কাবেরী।
কোম ইরানে শিয়াদের ধর্মীয় শহর। এখানে রয়েছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইমামজাদী মাসুমা (র.) মাজার। রয়েছে হামিদ কাদেরীর নিকট আত্মীয় আয়াতুল্লাহ মোস্তফা নাজাফী। শিয়াদের কাছে আয়াতুল্লাহ বলতে ধর্মীয় মুরব্বি, মুফতি। আমরা কোমে সরাসরি আয়াতুল্লাহ মোস্তফা নাজাফীর বাসায় যাই। তার ঘরে আতিথেয়তার পর তিনি আমাদেরকে কোম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাজাবীর বাসভবনে নিয়ে যান। তার বাসভবনের নিচতলা অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন।
আমি সুনি,্ন লেখালেখি করি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং শিয়া আকিদা বিশ্বাস নিয়ে জানতে চাই, তা এ দুই প্রখ্যাত আয়াতুল্লাহর কাছে জানা হয়ে আছে।
আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাজাবী ফার্সি, আরবির পাশাপাশি ইংরেজিতেও দক্ষ। এতে তারা উভয় আয়াতুল্লাহ মনে হয় মানসিকভাবে প্রস্তুত আমার প্রশ্নের উত্তরের লক্ষ্যে।
আমি প্রথম প্রশ্ন করলাম, আপনারা হযরত আলী (ক.) কে ইমাম মানেন না নবী মানেন? সাথে সাথে আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাদাবী দৃঢ়ভাবে বললেন, তারা অর্থাৎ শিয়ারা হযরত আলীকে ইমাম মানেন। তখন পুনঃ প্রশ্ন করলাম, ইরানে এমন কিছু এলাকা, গোষ্ঠী আছে যারা হযরত আলীকে নবী মানেন। এতে তিনি দৃঢ়ভাবে তা অস্বীকার করলেন। তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, বিশ্বে এমন কিছু লোক বা গোষ্ঠী আছে যারা তাদের (শিয়াদের) বিরুদ্ধে দুর্নাম/বিদ্বেষ ছড়ায়। তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে আরও বললেন, হযরত মুহাম্মদ (স.) শেষ নবী এবং হযরত আলীর শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা সবকিছু হযরত মুহাম্মদ (র.) থেকে প্রাপ্ত।
আমাদের ভ্রমণকালীন ইরানে ইমাম মেহেদীর জন্মবার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি দেখছিলাম বিধায় প্রশ্ন করলাম: আপনারা কি ইমাম মেহেদী জন্মগ্রহণ করেছেন বিশ্বাস করেন? এতে তিনি বললেন, আপনারা (সুন্নিরা) ইমাম মেহেদী এখনও জন্মগ্রহণ করেননি বিশ্বাস করেন। কিন্তু তারা (শিয়ারা) ইমাম মেহেদী জন্মগ্রহণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহ পাক তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন যা সময় হলে প্রকাশ পাবে। আর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন:২৫০ হিজরির ১৫ শাবান ইমাম মেহেদী জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি তাদের (শিয়াদের) শেষ ইমাম।
এখানে উল্লেখ্য, শিয়াদের ১২ ইমাম এবং শিয়ারা নবীজী (স.) এর পর ইমাম প্রথায় বিশ্বাসী। ১ম ইমাম-হযরত আলী (ক.) যিনি ইরাকের কুফা নগরীর ১০ কি.মি দূরত্বে নজফে শায়িত। ২য় ইমাম-হযরত হাসান (রা.)। তিনি মদিনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাকীতে শায়িত। ৩য় ইমাম- হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) যাঁর শরীর মোবারক কারবালায় এবং মস্তক মোবারক কায়রো নগরীতে শায়িত। ৪র্থ ইমাম-হযরত জয়নুল আবেদীন (রা.); মদিনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাকীতে শায়িত। ৫ম ইমাম- হযরত বাকের (রা.) জান্নাতুল বাকীতে শায়িত। ৬ষ্ঠ ইমাম- হযরত জাফর সাদেক (রা.); জান্নাতুল বাকীতে শায়িত। হযরত ইমাম হাসান, হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন, হযরত ইমাম বাকের ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক জান্নাতুল বাকীতে আহলে বায়তের বিশেষ এরিয়ায় পর পর শায়িত। ৭ম ইমাম-হযরত মূসা কাজিম (রা.); ইরাকের রাজধানী বাগদাদে শায়িত। ৮ম ইমাম-হযরত আলী রেজা (রা.); ইরানের মা’শাদ শহরে শায়িত। ৯ম ইমাম- হযরত মুহাম্মদ জাওয়াত তর্কী (রা.) বাগদাদে ইমাম হযরত মুসা কাজিমের পাশে শায়িত। ১০ম ইমাম-হযরত আলী আন-নকী (রা.) ও ১১ তম ইমাম-হযরত আল-হাসান আল আসকারি, ইরাকের রাজধানী বাগদাদের দেড়শত কি.মি উত্তরে সামরায় একই এরিয়ায় শায়িত এবং ১২ তম ইমাম- হযরত মেহেদী (আ.) জন্ম হলেও প্রকাশ উহ্য রয়েছে।
শিয়া আকিদা মতে বৎসরের বড় উৎসব হল হযরত ইমাম মেহেদী (রা.) জন্মবার্ষিকী পালন ১৫ শাবান। ঐ দিবসকে সামনে রেখে তারা ব্যাপক উৎসবের আয়োজন করে। আয়োজন করে রাস্তাঘাটে পথিককে খাওয়ানো, অফিস-আদালতে, ঘর-বাড়িতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা ইত্যাদি। ঐদিন সমগ্র ইরানে উৎসবের আমেজ বিরাজ করতে থাকে।
আমার তৃতীয় প্রশ্ন ছিল: কালেমা নিয়ে। শিয়া আকিদা মতে মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহর পর আলীও অলিউল্লাহ বলে থাকে। এতে আয়াতুল্লাহ বললেন, মূল কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ। অতঃপর আলীও অলীউল্লাহ কালেমার অংশ নয়। না বললেও চলে।
৪র্থ প্রশ্ন: নামাজ জমা কেন? অর্থাৎ জোহর, আসর ও মাগরিব, এশার পর পর পড়া হয় কেন? যা সুন্নিমতে সফরে করা হয়ে থাকে। এতে আয়াতুল্লাহ বললেন, হাদীস শরীফ মতে গ্রহণযোগ্য। প্রয়োজনে তারা হাদীস শরীফ দেখাতে পারবেন।
৫ম প্রশ্ন: মসজিদের ভিতরে-বাহিরে হযরত আলী (ক.) ও ইমাম হোসাইন (রা.) ছবি কেন? এবং তা গ্রহণযোগ্য কি না? উত্তরে বললেন গ্রহণযোগ্য নয়। তবে হারামও নয়।
৬ষ্ঠ প্রশ্ন: মোতা এখনও জায়েজ মনে করেন কি না? উত্তর-অবশ্যই জায়েজ, বর্তমানে আরবের শেখরাও মোতা বিবাহ করতেছেন। তা না হলে তাদের চারের অধিক স্ত্রী থাকে কি করে। মোতা বিবাহের দ্বারা খারাবী রহিত হচ্ছে।
৭ম প্রশ্ন: অযুতে পা না ধুয়ে মোছেহ করা হচ্ছে। সুন্নিমতে বিশেষ অবস্থায় করা হয়। আপনারা সব সময় করছেন। উত্তর: হাদীস শরীফমতে গ্রহণযোগ্য।
৮ম প্রশ্ন: সুন্নিগণের কাছে প্রচার আছে আল্লাহ তা’য়ালা জিবরিলকে নবুওয়াত নিয়ে প্রেরণ করেন হযরত আলী (ক.)’র কাছে, কিন্তু ভুলক্রমে হযরত মুহাম্মদ (স.)কে নবুওয়াত দেয়া হয়। উত্তর: সম্পূর্ণ মিথ্যা। একটু আগেও বলেছি, হযরত মুহাম্মদ (স.) শেষ নবী এবং হযরত আলী (ক.)’র শিক্ষাজ্ঞান সবকিছু হযরত মুহাম্মদ (স.) থেকে প্রাপ্ত।
এসব বক্তব্য আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়।
৯ম প্রশ্ন: আজানে হযরত আলী (রা.)’র নাম নেয়া হচ্ছে কেন? উত্তর: এসব শর্ত নয়। না বললেও চলে।
১০ প্রশ্ন: হযরত আবু বক্কর (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) কে খলিফা মানেন কি না? উত্তর: উনারা দু’জনেরই বিশাল খেদমত রয়েছে এবং তাঁরা দু’জন নবিজীর সাথে থেকেই ইসলামের খেদমত করে গেছেন। তাঁরা উঁচুমাপের সাহাবা এবং তাঁদের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। কিন্তু আমরা (শিয়ারা) ইমাম মেনে থাকি।
আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাদাবী এর সাথে আয়াতুল্লাহ নাজাফি এবং হামিদ কাবিরীও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করেছিলেন বা সহযোগিতায় ছিলেন। আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাদাবী এর বাড়ীতে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে দুপুরের খাবার খেতে পুনঃ আয়াতুল্লাহ মোস্তফা নাজাফির ঘরে ফিরে আসি। যেহেতু তিনি আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
খাবারপর্ব শেষ বিকেলের দিকে আমরা তিনজন তেহরানের পথে রওনা দিই।
বস্তুতঃ ফাহলভী শাহ’র আমলে দীর্ঘ সময় ইরানের সাথে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিকভাবে সুসম্পর্ক ছিল। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের ইতিহাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়।
ইমাম খোমেনী দেশের নামকরণ করেন ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান। বিলাসী জীবন পরিহার করে কর্মঠ হন ইরানীরা। পশ্চিমাদের নানা বিধি নিষেধ অবরোধের পরেও ইরান থেমে নেই। ইরানীদের জীবনযাত্রায় দেখবার জানবার অনেক কিছু আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইরান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করতে গুরুত্বারোপ করি জ্ঞার্নাজনের জন্য। এ তিন দেশের মুসলমানদের জীবনযাত্রা কত সুন্দর, উন্নত। সে তুলনায় আমাদের অবস্থান কোথায়!
তবে শিয়াদের ২টি বিষয় আমাকে অবিভূত করে।
(১) কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদী নবী পাক (স.)’র শানে কলংক আনতে ঝধঃধহরপ ঠবৎংবং বই লিখেন। এতে মুসলিম বিশ্বের কোন রাজা বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর টনক নড়েনি। একমাত্র ইমাম খোমেনী তাকে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম খোমেনী ইন্তেকাল করে গেছেন, কিন্তু কুখ্যাত সালমান রুশদীকে হত্যার ফতোয়া রয়ে গেছে। অতএব আমৃত্যু তার প্রকাশ্যে আসা সম্ভব হবে না।
(২) আমাদের দেশের প্রায় ৬ গুণ বড় এই ইরানের বড় বড় শহরে এক বা একাধিক বার যাওয়া হয়েছে। তাদের যে কোন অনুষ্ঠানে আল্লাহর রাসূল (স.)’র নাম নিলে উপস্থিত সকলে সমস্বরে দরূদ শরীফ পাঠ করবে আর তা হল ‘আল্লাহুম্মা ছল্লিয়ালা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ।
এক বৈঠকে বক্তা যতবারই আল্লাহর রাসূল (স.)’র নাম নিবে ততবারই উপস্থিত সকলে ততবার সমস্বরে এই দরূদ শরীফটি পড়বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধকরোনায় চট্টগ্রামে নতুন ১০ জন আক্রান্ত