চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ সাথে কোরবানিগঞ্জ, টেরীবাজার, আমির মার্কেট, আছাদগঞ্জ কর্ণফুলীর তীরে যথাযথ গভীরতায় চাক্তাই খাল কেন্দ্রীক দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ৭/৮ বর্গ কি.মি এরিয়া নিয়ে এই অঞ্চলটি ছিল ব্যবসা–বাণিজ্যের কোলাহলে। শত শত অফিস, ব্যাংক, সাথে দামি দামি রেস্টুরেন্টে সকাল ৯ টা থেকে বিকেল পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের কোলাহলে থাকে। খালের পূর্ব পার্শ্বে চাক্তাইতে অসংখ্য বড় বড় গুদাম। চাক্তাই খালের পূর্ব পার্শ্বে খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আমির মার্কেট, আছাদগঞ্জ, টেরী বাজার এই সব এলাকায় শত শত ব্যবসায়িক অফিস সাথে গুদাম, ব্যাংকের পাশাপাশি রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও কম নয়।
৫/৭ তলা বড় বড় দালানের নিচতলা তো বটেই ২,৩,৪ তলায় আমদানি রপ্তানি ইনডেন্ট ট্রেডিং এর ছোট বড় অফিস। এসব অফিস অনেকটা ল্যান্ড টেলিফোনের উপর নির্ভরশীল তথা সরাসরি সরকারী টিএন্ডটি টেলিফোন ব্যবহার করে। বর্তমানে মোবাইল সহজলভ্য। কিন্তু সরকারী ল্যান্ড টেলিফোন সহজ ছিল না ধারণ ক্ষমতার তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায়। ব্রিটিশ আমল পেরিয়ে পাকিস্তান আমলের পুরো ২৩ বছর এই এলাকাটি ছিল ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য সারা দেশে প্রসিদ্ধ। ঐ সময় সাগরপথে ছাড়া আমদানি রপ্তানি এত সহজ ছিল না। তেমনি আকাশ যোগাযোগেও নয়। পাকিস্তান আমল পেরিয়ে ১৯৭০ এর দশকেও বিমান ছিল ছোট ছোট। অতএব সেই সময় এত বড় বড় কার্গো বিমানের প্রশ্নই আসে না।
কর্ণফুলী নদীর গুরুত্ব ও গভীরতা সাথে সাথে চাক্তাইখালের যথাযথ প্রশস্ততা ও গভীরতা ৭/৮ বর্গ কি.মি এর এই এলাকাটি অতীব সমৃদ্ধ করে তুলে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গেলে আমাদের এই অঞ্চলে পশ্চিম পাকিস্তানের হাজার হাজার ব্যবসায়ী আসতে শুরু করে। তারা খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আমির মার্কেট,আছাদগঞ্জ অফিস খুলে বসে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তরা দালান ভাড়া নিয়ে বা ক্রয় করে বসবাস করতে থাকে।
১৯৪৭ সালের দু’য়েক বছরের ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা চট্টগ্রামে নাসিরাবাদ এলাকায় হাউজিং সোসাইটি গড়ে তুলে বসবাসের লক্ষে। নাম দেয় “দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি”। এতে বাংলাদেশী একদম ছিল না তা নয়। তারা এখানে অফিস মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে । পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে খুলশী হিল্সে তারা ২য় প্রকল্প হিসেবে সম্প্রসারণ করে।
খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আমির মার্কেট, আছাদগঞ্জে নিচতলায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের একাধিক ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যথা–হাবিব ব্যাংক–আজকের অগ্রণী ব্যাংক, ইউনাইটেট ব্যাংক–আজকের জনতা ব্যাংক, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক আজকের রূপালী ব্যাংক। সাথে এই অঞ্চলের ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক–আজকের পূবালী ব্যাংক। অবশ্য সে সময় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান আজকের সোনালী ব্যাংক এর গুরুত্ব কম নয়। এই সময় ব্যাংকগুলো আমদানি রপ্তানিতে অনেকটা দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছতায় ব্যবসা–বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে।
১৯৫০ এর দশকে চাক্তাই খালের যেমনি গভীরতা ছিল তেমনি ছিল স্বচ্ছ পানি, মানুষ ওযু গোসল করত। মাল বোঝায় বড় বড় ট্রলার বিভিন্ন ঘাটে ভিড়ত। এই এলাকা থেকে সারা দেশে মালামাল সাগরপথে নদীপথে পরিবহন করা হত।
কর্ণফুলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। ছোটকালে ১৯৫০ এর দশকে শহর দেখতে আসতাম। যেহেতু বিদ্যুতের লাইট ফ্যান উপভোগ, সাথে মজাদার আইসক্রিম, মিষ্টান্ন সহজলভ্য শহরে। যা গ্রামে নয়। বাঁশখালী থেকে শঙ্খ নদী পার হয়ে খাল দিয়ে কর্ণফুলীতে পৌঁছা। কর্ণফুলী অতিক্রম করে চাক্তাইখাল দিয়ে মিয়াখান নগর পৈতৃক বাড়িতে পৌঁছা। যা চাক্তাইখালের পূর্বপাড়ে। মিয়াখান নগর হলেও মূল এরিয়া হল বাকলিয়া। বাকলিয়া বলতে গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ। যদিও বা এখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল, ওয়াসার লাইন তখন সম্প্রসারণ হয়নি। ফলে জনকল্যাণে আমার পিতা একটি নলকূপ দিয়েছিলেন। ঐ সময় মাটির নিচ থেকে পানি তোলার প্রবণতা কম থাকায় পানির স্তর অনেক উপরে ছিল। এই নলকূপ আশেপাশে শত শত মানুষের চাহিদা মেটাত।
বাকলিয়ার মানুষ চাক্তাই খালের পশ্চিমপাড়ে আসতে শহরে যাচ্ছি বলত। সপ্তাহখানের জন্য শহরে আসলে লালদীঘির পাড়ের পাশাপাশি খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আমির মার্কেট, টেরী বাজার এই সব এলাকায় ঘুরা হত। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠে। তাদের খাবারের রুচি আর আমাদের খাবারের রুচি ব্যবধান। তাদের খাবারে তথা সকালের নাস্তায় পরোটা, নানরুটি, মগজ, পায়া, কলিজা, মুরগীর সুপ ইত্যাদি থাকত, মানুষও খেত। দুপুরের খাবারে বিরানি, খিমা, পায়া, গোস্তকারী, গোস্তভুনা, রুটি, পোলাও ভাত ইত্যাদিতে ভরপুর থাকত। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারে ব্যাপক কাস্টমার থাকত। বিকেল হতে হতে এলাকাটি অনেকটা নিস্তব্ধ হয়ে যেত। ব্যাংক বন্ধ ব্যবসা বাণিজ্যের অনেক কিছু বন্ধ। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে ভিন্ন পরিবেশ। এ সময় লাচ্ছি ফালুদাসহ এই জাতীয় নানান আইটেম বিক্রি হত।
ঐ সময় আগ্রাবাদ প্রতিষ্ঠা ও গুরুত্ব শুরুর দিকে বলা যাবে। আগ্রাবাদের কার্যক্রম শুরু হয় অনেকটা ১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে। ১৯৬০ এর দশকে আগ্রাবাদ ব্যবসা–বাণিজ্যের অতীব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলেও চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবাণীগঞ্জ, আমিন মার্কেট, আছাদগঞ্জের গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। যেহেতু কর্ণফুলী সাথে চাক্তাই খাল এই অঞ্চলের গুরুত্বকে ধরে রাখে।
ঐ সময় চট্টগ্রামের দামি আবাসিক হোটেল ছিল স্টেশন রোডের মিসকাহ। অতঃপর সদরঘাটের শাহজাহান হোটেল। এরপর স্টারমানের আগ্রাবাদ হোটেল প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর স্থল যোগাযোগ ধারণাতীত উন্নতি লাভ করতে থাকে। প্রায় নদী খালের উপর ছোট বড় ব্রীজ হয়ে গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে স্থল যোগাযোগও বৃদ্ধি পায়। আগ্রাবাদের গুরুত্বও বাড়তে থাকে। পলিথিন, পলি মাটিতে খাল নদী ভরাট হতে থাকে। গ্রীণ হাউসের প্রভাবে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে। এতে বর্ষাকালে অনেক সময় রোদ থাকা অবস্থায় পূর্ণ জোয়ারে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ পানিতে তলিয়ে যায়। গুদামে পানি ঢুকে মানুষের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হতে থাকে। প্রায় দালানে নিচতলায় পানি ঢুকে যায়। পর্যায়ক্রমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করতে শুরু করে। ব্যবসায়ীগণের মধ্যে অনেকে উৎসাহ উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে।
কর্ণফুলী ভরাট হয়ে গেছে আগের গভীরতা নেই। চাক্তাই খাল ভরাট হয়ে এখন বড় বড় মালবাহী ট্রলার তো নয়ই ছোট ছোট নৌকা সাম্পান চলার মত পরিবেশ আছে মনে হয় না। চাক্তাইখালের পানি অনেকটা গন্ধ, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর অবস্থাও নাজুক। আগের মত পরিচ্ছন্ন পানি নেই। এই এলাকায় আমাদের দেশীয় হাজারো ব্যবসায়ীর মধ্যে অধিকাংশের মধ্যে প্রশান্তি আছে বলে মনে করি না। সে সময় ব্যাংকগুলো ব্যবসা–বাণিজ্যের মূল নিয়ন্ত্রক ছিল, ছিল স্বচ্ছতা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে। আজ সেই ব্যাংক লুটপাটের অবলম্বন হয়ে গেছে। যেখানে ব্যাংক লুটপাট দেউলিয়ার পথে সেখানে সুন্দর স্বচ্ছ ব্যবসা–বাণিজ্য থাকার কথা নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।












