এই উপমহাদেশে শায়িত তিনজন রসূলনোমা
আমাদের এই উপমহাদেশে তথা ভারতবর্ষে তিনজন রসূলনোমার তথ্য রয়েছে। তৎমধ্যে অবিভক্ত বাংলায় প্রসিদ্ধ রসূলনোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)। তাঁর জন্মস্থান লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিক সোবহানে। কিন্তু ইন্তেকাল হয়ে শায়িত রয়েছেন কলকাতা মহানগরীর মানিকতলায়। অপরজন ভারতের উত্তরপ্রদেশের বানারস শহরে শায়িত। তিনি হলেন হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেশ কাদেরী। তৃতীয় জন হলেন হযরত হাসান দেহলভী দিল্লীতে শায়িত। ১১০৩ হিজরিতে দিল্লীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বিষয়ে আমার আগে থেকে কোন তথ্য তালাশ বা ধারণা ছিল না।
রসূল নোমার সরাসরি অর্থ রসূল প্রদর্শক। অর্থাৎ রসূল (স.) কে প্রদর্শনকারী। যিনি রসূল (স.) কে দেখাতে পারেন। আল্লাহর রসূল (স.)’র ওফাতের পর রসূল প্রেমিকগণের মধ্যে অনেকই বিভিন্নভাবে বিশেষ অবদানে মূল্যায়নে বিশেষ সম্মানিত হিসেবে স্বীকৃত রয়েছেন। বিশেষ করে আশেকে রসূল (স.) হিসেবে হযরত ওয়ায়েজ করনি, সুফি তত্ত্বে ইমাম হাসান বসরী, ফিকাহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা; হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী, আউলিয়া সম্রাট হিসেবে বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী, গরীবে নওয়াজ হিসেবে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি আজমেরী। কাব্য জগতে হযরত শেখ সাদী, ফানাহ ফিল্লাহ জগতে হযরত মনসুর হাল্লাজের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
রসূলনোমা একটি বিশেষ সম্মানিত লকব। রসূলনোমার সরাসরি অর্থ রসূল প্রদর্শক। অর্থাৎ রসূলকে প্রদর্শনকারী। যিনি রসূল (স.) কে দেখাতে পারেন।
গত ২ বছর আগে কলকাতা হয়ে বানারস গমন করা হয় রসূলনোমা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেশ কাদেরীর যেয়ারত করার উদ্দেশ্যে। বানারস পুরাতন শহরের একটি প্রকান্ড জামে মসজিদের চত্বরে তিনি শায়িত।
বানারসের এই রসূলনোমা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেশ কাদেরী যৌবনের শুরু থেকে একজন ধর্মীয় ওস্তাদ ছিলেন। এলমে হাদীসের জ্ঞানার্জন করেন সেই প্রখ্যাত ওস্তাদ হযরত হায়াত সিন্দী থেকে। রসূলনোমা হযরত ওয়ারেশ কাদেরী ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুফতিও। জনগণের ধর্মীয় সমাধান দিতেন। সেকালে বড় বড় আলেম সুফি দরবেশগণ তাতে সমীহ করতেন। তিনি ছিলেন শরীয়তের পাশাপাশি মারফত জ্ঞানের ভান্ডার। ধর্মীয় যে কোন আলোচনা মজলিশে তাকে সম্মান দেখিয়ে সম্বোধন করা হত।
সাধারণ মানুষের মাঝে রসূলনোমা হিসেবে পরিচিত লাভ করলেও তিনি ছিলেন তরিকত জগতে জ্ঞানের ভান্ডার তেমনি মারফত জগতের একজন শেখ। তাঁর দেয়া যে কোন ধর্মীয় সমাধান সকলে বিনা দ্বিধায় মেনে নিতেন। তিনি এলমে তাসাউফের উচ্চ মর্তবাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রায় সময় মোরাকাবা ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহর রসূল (স.)’র সান্নিধ্যে লাভের সৌভাগ্যবান ছিলেন। যে কোন মানুষ তাকে দেখলে পরিপূর্ণ বুজুর্গ হিসেবে স্বীকার করতেন। তিনি দ্বীন–দুনিয়ার যে কোন কাজ আল্লাহর রসূল (স.)’র অনুমতি ছাড়া করতেন না। অনেক মানুষ তার ওছিলায় তথা মাধ্যমে মদিনা মুনাওয়ারায় রওজাপাকের যেয়ারত লাভ করেন। তিনি রুহানীভাবে মদিনা মুনাওয়ারা রওজাপাকের সাথে সম্পৃক্ততায় থাকতেন। তখন একজন মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব লিখেন, হযরত রসূলনোমা ওয়ারেশ কাদেরী ঘুমানোর সময় পা লম্বা করে ঘুমাতেন না। দুই হাঁটু বাকা করে ঘুমাতেন। খাদেমগণকে উত্তরে বলতেন, আমি পা লম্বা করে ঘুমাতে পারি না কারণ ইহা আল্লাহর রসূল (স.)’র সাথে বিয়াদবী হবে। পুরো জীবন এইভাবে কাটিয়ে দেন। তিনি ছিলেন ফজিলতপূর্ণ এলম জ্ঞানের সাগর। শরীয়তের মাসালাহ সম্পর্কে অদ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর মুরিদের সংখ্যা অসংখ্য, তৎমধ্যে আলেমের সংখ্যা ব্যাপক। তাঁর শানে অনেক উপাধি ব্যবহৃত হয়। যেমন–সামশুলওলামা, সামশুদ্দিন, সিরাজুল ফোকাহাহ, কুত্বুল আউলিয়া ইত্যাদি।
তাঁর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি এশকে রাসূলে বিভুর থাকতেন। আল্লাহর রসূলের সাথে ভালোবাসা জ্ঞানের কারণে নয়, বরং ফিতরতই ছিল। বুঝ শক্তি আসার শুরু থেকেই বয়সের সাথে সাথে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এই যেন মহান দয়া। আল্লাহর রসূল (স.)’র প্রতি প্রেমময় কবিতা পড়তেন আবার কখনও অধৈর্যতাও প্রমাণ পেত। দু’বছর এভাবে কেটে গেল। পরিশেষে বিরহের যন্ত্রণাও কেটে গেল। অপেক্ষার কন শেষ হল। জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহর রসূল (স.) তাঁর সামনে শুভ আগমন করা নিজেকে তার সামনে প্রদর্শন করে তাকে সফলকাম বানানো। এত বড় সৌভাগ্য ছিল যা নগন্য সংখ্যক অলিদের দেয়া হয়। হযরত ওয়ারেশ কাদেরী এই মর্যাদা পেয়ে গেলেন যে, দর্শন প্রার্থীদেরকে আল্লাহর রাসূল (স.)’র যেয়ারত দ্বারা ধন্য করানোর সৌভাগ্য লাভের মাধ্যমে। এই মর্যাদার নামই রসূলনোমা। এই হতে হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেশ কাদেরী নামের পূর্বে রসূলনোমা উপাধি মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত করে। তিনি ১১৬৬ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ৬৩ বছর আগে দিল্লী রসূলনোমা হযরত হাসান দেহলভী ১১০৩ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
হযরত ওয়ারেশ কাদেরীর আরও প্রায় ৮০ বছর পর ভারতবর্ষে অপর রসূলনোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র জন্ম হয়।
হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র জন্ম সন ১২৩০ বাংলা ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া মল্লিক সোবহানে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটকালে আব্বা ইন্তেকাল করেন। এক বর্ণনায় বালাকোটের যুদ্ধে শহীদ হন। হযরত সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী আম্মাজানকে নিয়ে হজে গমনকালে হুগলি নদীর মোহনায় জাহাজ নিমজ্জিত হয়। এতে তিনি কলকাতাতেই থেকে যান। হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী শৈশবকাল থেকে আরবি ফার্সি উর্দুতে প্রভুত জ্ঞানার্জন করেন। হুগলি মাদ্রাসা এবং হাওড়া জেলার দশা মাদ্রাসা থেকে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। তিনি বেশকিছু ধর্মীয়গ্রন্থ চর্চা করেন। ফার্সি ভাষায় তাঁর রচিত দিওয়ানে ওয়াইসী ১৭৯ টি গজল ২৩ টি কচিদার সমন্বয়ে মহান অমূল্যগ্রন্থটি উপমহাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগায়। তিনি বালাকোটের গাজী হযরত নুর মোহাম্মদ নিজামপুরীর নিকট মুরিদ হন। পরবর্তীতে খেলাফত লাভ করেন। ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ জেলার পুনাশি গ্রাম থেকে ফাতেমা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তথায় তিনি আবাস স্থাপন করেন। শরীয়ত ও তরিকতের কঠোর মেহনতের কারণে তাঁর শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ঐদিন ছিল ৮ রবিউল আউয়াল ১৩০৮ হিজরি ২০ অগ্রহায়ণ ১২৯৩ বাংলা ৬ ডিসেম্বর ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ। তাঁকে কলকাতা মহানগরীর মানিকতলা মুন্সিপাড়ার দিল্লীওয়ালা কবরস্থানে শায়িত করা হয়।
হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী ইন্তেকালকালে ৩৫ জন খলিফা রেখে যান। ফুরফুরা হযরত আবু বকর ছিদ্দিকী, হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী, হযরত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী, হযরত সুফি একরামুল হক সহ উপমহাদেশখ্যাত বুজুর্গ ব্যক্তিত্বগণ তাঁর খলিফা।
হযরত ওয়াইসীর অন্যতম খলিফা ফুরফুরা হযরত আবু বকর ছিদ্দিকী বর্ণনা করেন, এক সময় হযরত ওয়াইসী তাকে নিয়ে জুমার নামাজ পড়তে ঘর থেকে বের হন। পথিমধ্যে তাঁর মুরিদের মনে এইভাব জাগে যে, তাঁর পীর ছাহেব রসূলনোমা অবস্থা তিনি দেখতে চান। এতেই তার মুরিদ ওযু করে মসজিদে প্রবেশ করা মাত্রই ইমামের নামাজের স্থানে আল্লাহর রসূল (স.) কে দেখতে পান এতে তিনি আবেগভরে দেখতে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তৎস্থানে তিনি তাঁর পীর ছাহেবকে দেখতে লাগলেন। এভাবে পীর তার মুরিদকে রসূলনোমা তথা ফানাফির রসূল হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দেন।
হযরত ওয়াইসীর অপর বিখ্যাত খলিফা সুফি একরামুল হক (রহ.) একবার আসরের নামাজের আগে আগে তাঁর পীর ছাহেব যে রসূলনোমা তা বুঝতে চাইলেন। এতে তাঁর পীর ছাহেব তাকে বললেন, আগে আসরের নামাজ সেরে নিই তারপর হবে। আসরের নামাজ পড়াকালীন তিনি তাঁর পীর ছাহেবকে হঠাৎ করে আল্লাহর রসূল (স.) হিসেবে দেখতে পান। পুনঃ দৃষ্টি দেয়ার সাথে সাথে দেখলেন যে, এই ব্যক্তিত্বই তো তাঁর পীর ছাহেব। আসরের নামাজের পরপর তাঁর পীর ছাহেব মুরিদ তথা খলিফার আগ্রহের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে বললে হযরত সুফি একরামুল হক (রহ.) ক্ষমা চেয়ে এড়িয়ে যান। হযরত সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র জীবনে আল্লাহর রসূল (স.)কে নিয়ে এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। যা প্রবেন্ধর কলবর বৃদ্ধি হচ্ছে বলে উল্লেখ করলাম না।
আমাদের দেশে তাঁর প্রথম জীবনীগ্রন্থ লিখার সৌভাগ্য হয় আমার। কলকাতা গেলেই তাঁর যেয়ারতে গমনে ভুল হয় না। গত ২ বছর আগে বানারস গমন করলে রসূলনোমা সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেশ কাদেরীর যেয়ারত করা হয়। দিল্লীতে শায়িত হযরত হাসান দেহলভীর তথ্যটি পাই আরও পরে। উপমহাদেশে তিনজন রসূলনোমা শায়িত থাকায় আমরা গর্বিত বলতে পারি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।









