ইস্তাম্বুলে মসজিদ কেন্দ্রীক সুলতানগণের সমাধি। ১৪৫৩ সালে সুলতান ২য় মুহাম্মদ কর্তৃক ইস্তাম্বুল জয়ের পর এখানে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। সেই হতে প্রায় ৪ শত বছরব্যাপী ওসমানীয় সুলতানগণ এই ইস্তাম্বুলে বসে বিশ্ব শাসন করে গেছেন। সুলতানেরা ইন্তেকালের পর ইস্তাম্বুলে সমাধিস্থ হন। ফলে ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সুলতানগণের সমাধি তথা কবর বা মাজার। কিন্তু তারা মসজিদ নির্মাণ করে মসজিদে কেবলার দিকে মাত্র কয়েক শতক এরিয়া নিয়ে সুলতান নিজে স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে শায়িত অর্থাৎ সুলতানের পরিবার পরপর শায়িত হন।
সুলতান ২য় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুল জয়ের পর বয়স বাড়লে একটি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন প্রকান্ড মসজিদ নির্মাণ চিন্তা রাখেন। ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কে আমাদের দেশের মত দ্বিতল মসজিদ দৃষ্টিগোচর হবে মনে হয় না। প্রকান্ড এক গম্বুজ বিশিষ্ট ২০/৩০ ফুট বা কম বেশি উচ্চতায় একতলা মসজিদ। কেবলার দিকে বাদে অন্য তিন দিকে বেলকনি। যেখানে মহিলারা নামাজ পড়েন। তেমনিভাবে সুলতান ২য় মুহাম্মদ ইন্তেকাল জয় করলে পর ইন্তেকাল হলে মসজিদ সংলগ্ন কেবলার দিকে তাকে কবরস্থ করা হয়। এই কবরকে কেন্দ্র করে হয়ত ১৫ বাই ১৫ ফুট ছোট এক গম্বুজের মাজার বা সমাধি নির্মাণ করা হয়। এর আশেপাশে তার পরিবারবর্গের অন্যান্যদের কবর।
সুলতান ১ম সেলিম যিনি ১৫১৭ সালে হেজাজের নিয়ন্ত্রণে নেন। মক্কা মোকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারার খাদেম হতে পেরে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। তারই পুত্র সুলতান সুলায়মান। তিনি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ ৪৬ বছর বিশাল সাম্রাজ্য একটানা শাসন করে গেছেন। পাহাড়–পর্বতের শহর ইস্তাম্বুল। ইউরোপ–এশিয়া দুই মহাদেশের সমন্বয়ে এই মহানগর। ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশ অতীব সমৃদ্ধ। এখানেই গোল্ডেন হর্ণের তীরে অপ্রতিরোধ্য দুর্গ জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন সুলতান ২য় মুহাম্মদ। এই ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশের এক পাহাড়কে কেন্দ্র করে সুলতান সুলায়মান বিশ্বখ্যাত মসজিদ নির্মাণ করেন। যাকে ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড মসজিদ বা প্রধান মসজিদ বলা হয়। দু’টি মসজিদ অতীব প্রসিদ্ধ। এক ব্লু মসজিদ অর্থাৎ সুলতান আহমদ মসজিদ। আরেকটি সুলতান সুলায়মান নির্মিত বা গ্র্যান্ড মসজিদ। গ্র্যান্ড মসজিদে কেবলার দিকে সুলতান সুলায়মান ২/৩ শতক এরিয়া নিয়ে তার পরিবারবর্গ সহ শায়িত। এখানেও সুলতান সুলায়মানের কবরটি প্রায় ১৫ বাই ১৫ ফুট এরিয়া নিয়ে ছোট এক গম্বুজের কাঠামো। ছোটখাটো সমাধিও বলা যায়, মাজারও বলা যাবে।
সুলতান ২য় আবদুল হামিদ। ফিলিস্তিন পাওয়ার জন্য ইহুদি ধনকুবেরা নানাভাবে তাঁর নিকট প্রচেষ্টা চালায়। যেহেতু ওসমানীয় সাম্রাজ্য তখন আর্থিক প্রতিকূলতায়। কিন্তু সুলতান অর্থের লোভে তাদের সাথে আপোষ করেননি।
ফ্রান্সে আল্লাহর রাসুল (স.)’র নামে একটি ভিডিও বানাতে চাচ্ছিল। প্রতিকূল অবস্থায়ও সুলতান আবদুল হামিদের হুঙ্কারে ফ্রান্স তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। যেমন আরব বসন্ত আরব রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করেছে তেমনি ব্রিটিশ ফ্রান্সের গোয়েন্দাদের সহায়তায় গণতেন্ত্রর নামে তুরস্কের খেলাফতকে দুর্বল করে দেয়। ফলে সুলতান আবদুল হামিদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর দু’য়েক জন সুলতান ছিলেন অনেকটা নামে মাত্র। এই সুলতান আবদুল হামিদ শায়িত রয়েছেন ইস্তাম্বুলের একটি প্রধান সড়কের পাশে মসজিদ কেন্দ্রীক ছোটখাটো কবর স্থানে। সেই একই আকৃতির ছোটখাটো এক গম্বুজের নিচে। সুলতান আবদুল হামিদের পর থেকে গণতন্ত্রের নামে ইউরোপের গোলামিতে পরিণত হচ্ছিল ওসমানীয় সালতানাত। আসে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্ব। তার সময়কালে ইসলামের উপর কঠোর দমন নিপীড়ন চলে। কিন্তু ১৯৫০ এর দশকের পর থেকে তুর্কিদের মাঝে ইসলামী ভাব ধারা ফিরে আসতে শুরু করে। যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পরপর তিনবার তুরস্ক সফর করা হয়েছিল। এতে ইস্তাম্বুল জয়কারী সুলতান ২য় মুহাম্মদ, সুলতান সুলায়মান এবং সুলতান আবদুল হামিদসহ আরও ২/১ জন সুলতানের যেয়ারত করার সুযোগ হয়। তুর্কিদের মাঝে তাদের প্রতি মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা দেখে অভিভূত হই।
অপরদিকে ভারতবর্ষে সুলতানী আমল মোঘল আমলসহ নানান রাজা–বাদশাহ তাদের স্ত্রীদের বিশাল বিশাল সমাধিসৌধ নির্মাণ করে গেছেন। এই সমাধিসৌধ নির্মাণ করতে এ কালের কত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে ভাবতে হবে। কিন্তু টিকেট কেটে এই সমস্ত সমাধিসৌধগুলো দেখছে, ঘুরছে, অবলোকন করছে, সাথে সাথে দর্শকদের মাঝে কাজ করছে চরম ঘৃণা। গরীব দুঃখীর জনগণের টাকা ব্যয়ের কারণে হোক, পারস্য আফগানিস্তান থেকে আগত হয়ে জবর দখলী শাসক হিসেবেও হোক। তারা মুসলমান ছিলেন, একটি প্রকান্ড মসজিদ নির্মাণ করে মসজিদের চত্বরে ছোটখাটো সমাধিসৌধ নির্মাণ করলে কি বা অসুবিধা ছিল। যা ইস্তাম্বুলের তুর্কি সুলতানগণের রয়েছে। কিন্তু ২/১ জন বাদে কেউ তা করেননি। কুতুবমিনার কম্পাউন্ডের ভিতর সুলতান ইলতুতমিসের কালো পাথরের মুড়ানো কবরটি হয়ত মসজিদের পাশে হওয়ার সম্ভাবনা যদিওবা মসজিদ বিলুপ্ত।
অপরদিকে তুর্কিরা সুলতানগণের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখিয়ে যাচ্ছেন যা যে কোন বিদেশীকে ভাবিয়ে তুলবে। জুমার নামাজের পর সূরা ফাতেহা পড়ে সুলতানগণের জন্য দোয়া করা হচ্ছে।
আজ তুর্কিদের অনুভূতিতে বুঝতে বাকী থাকছে না সুলতানগণের যোগ্য নেতৃত্বে তুর্কিরা বিশ্ব নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তারা বিলাসী জীবন যাপন করলেও তাদের কবরটা করে গেছেন মসজিদ কেন্দ্রীক।
অবশ্য তুর্কি সুলতানগণের মাঝে ধর্মীয় প্রভাব কাজ করছিল। যেমন ইস্তাম্বুল জয়ের পর মহান সাহাবা হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (র.) কে তারা আইয়ুব সুলতান হিসেবে স্বীকার করে। যিনি আল্লাহর রাসূল (স.)’র প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে তাদের বিশ্বাস। এখানেও প্রকান্ড দৃষ্টিনন্দন এক গম্বুজের মসজিদ।
ইস্তাম্বুল থেকে ৭ শত কি.মি পূর্ব–উত্তরে কোনিয়াতে শায়িত রয়েছেন হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। অপরদিকে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুল জয়ের পর দামেস্ক থেকে ধর্মীয় বিজ্ঞজন হযরত ইয়াহিয়া আফেন্দী ইস্তাম্বুলে আগমন করেন। ওসমানীয় সুলতান তাকে খুবই সমীহ করতেন। ফলে মহান সাহাবা হযরত আবু আইয়ুব আনসারী, হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি, ইয়াহিয়া আফেন্দী তথা ধর্মীয় মুরব্বিগণের প্রতি ওসমানীয় সুলতানগণ খুবই দুর্বল ছিলেন।
ইস্তাম্বুল জয়ের আগে বুরসা থেকে তুর্কি সালতানাত শাসন করা হত। যার নামে ওসমানীয় সাম্রাজ্য সেই ওসমান গাজী এই বুরসায় শায়িত। সাথে নিকটতম স্থানে তার যোগ্য পুত্র ওরহান শায়িত। পিতা পুত্র উভয়ে মাত্র শত মিটার বা কম বেশি দূরত্বে ছোট ছোট পৃথকভাবে দু’টি গম্বুজ নিয়ে সমাহিত। এর নিকটতম স্থানে বুরসা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। তৃতীয় বার তুরস্ক সফরকালে ইস্তাম্বুল থেকে সারাদিনের জন্য টেক্সী নিয়ে এই বুরসায় এসে দীর্ঘ সময় দেয়া হয়। এতে ওসমান গাজী ও ওরহানের সমাধিতে তুর্কি জনগণের যেয়ারত তথা শ্রদ্ধা প্রত্যক্ষ করি। এখানকার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদও খুব প্রসিদ্ধ। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম ক্যাবলকার।
বস্তুতঃ বিশ্বে নেতৃত্ব দানকারী ওসমানীয় সুলতানগণ ইন্তেকাল করলে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাহিত হতে মনে হয় মন থেকে তাড়িত হচ্ছিলেন। সেই মতে মসজিদ নির্মাণ করে মসজিদ সংলগ্ন সুলতান পরিবারবর্গ নিয়ে শায়িত। ফলে ৫ ওয়াক্ত জামাতের পর নামাজীরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুলতান ও সুলতানের পরিবারবর্গকে সালাম দিতে মন থেকে তাড়িত হওয়া স্বাভাবিক। যা মুসলমান রাজা–বাদশাহ প্রেসিডেন্ট–প্রধানমন্ত্রীগণের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলা যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট