পবিত্র মক্কা মোকাররমা। এই পবিত্র নগরীর উত্তর–পূর্ব দিকে প্রায় ৩/৪ কি.মি দূরত্বে পবিত্র পর্বত জবলে নূর। আরবীতে জবল বলতে পাহাড় বুঝানো হয়েছে। তার চেয়ে আরও বেশি উচ্চতায় হলে তাকে বলা হয় পর্বত। নূর পাহাড় বলা হলেও বাস্তবে পর্বত বলা যাবে। যেহেতু সক্ষম ব্যক্তি ব্যতীত যে কারও পক্ষে এখানে উঠা সহজ হবে না। আল্লাহর রাসূল (স.) এই পর্বত শীর্ষে গমন করতেন আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য লাভে ধ্যান তথা মোরাকাবা করতে। উম্মে খাতুন মোমেনীন হযরত খাদিজাতুল কোবরা খাবার ও পানি পৌঁছে দিতেন। এখানেই হযরত জিব্রাইল (আ.)’র আবির্ভাব হয় এবং এখানে প্রথম পবিত্র কুরআন মাজীদের আয়াত ‘ইকরা’ নাযিল হয়। হাজার বছর ধরে উম্মতে মুহাম্মদী বরকত হাছিলের জন্য এই পর্বতে উঠতে থাকেন। যা মনে হয় না কোন সময় থেমেছিল।
১৯২৪ সালে বাদশাহ আবদুল আজিজ তার দ্বিতীয় ও সাহসী পুত্র যুবক ফয়সালের মাধ্যমে হেজাজ নিয়ন্ত্রণে নেন। পবিত্র মক্কা পবিত্র মদিনা জেদ্দাকে নিয়ে বর্তমান সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চল বিশ্বের প্রাচীনকাল থেকে হেজাজ হিসেবে পরিচিত। সেই ২০২৪ সাল তথা শত বছর আগে থেকে শিরক বিদআতের নামে অনেক কিছু ভেঙে ধূলিসাৎ, অনেক কিছুতে কড়া প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল।
কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর পর মাত্র ১৫/২০ বছর আগে সৌদি কর্তৃপক্ষের বলি বা ধর্মীয় বিজ্ঞজনের কাছে বলি টনক নড়ে। তাদের মধ্যে হয়ত মহান আল্লাহপাক বুঝ শক্তি দান করেছেন ইতিহাস ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেয়া, রক্ষা করা শিরক বিদআত হতে পারে না। ইতিহাসকে রক্ষা না করলে মানুষ জানবে কি করে। তেমনিভাবে ১৫/২০ বছর বা তারও বেশি আগে থেকে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা নগরীতে মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করতে থাকে সৌদি সরকার।
এই জবলে নূরের পাদদেশেও তারা দু’টি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করে। জবলে নূরে গাড়ি এবং ক্যাবলকারে যাতায়াতের জন্য কাজ চলমান। মিউজিয়াম দু’টি চালু করা হয়েছে ২৯ জানুয়ারী ২০২৩ সালে। ১৫/২০ বছর বা কম বেশি সময়ের ব্যবধানে ওমরাহ মসজিদ তথা তনঈম বা মসজিদে আয়েশার কিছুটা আগে অতি আগ্রহ নিয়ে মিউজিয়াম দেখতে যাওয়া হয়েছিল। ১৫০ রিয়ালের টিকেট কেটে ক্লক টাওয়ারে উঠা হয়েছিল। মসজিদে নববীর পশ্চিমপাশে মিউজিয়াম এবং তা সরিয়ে দক্ষিণ পাশে দু’টি মিউজিয়ামে প্রবেশ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা জায়গায় টিকেটের ব্যবস্থা আছে।
পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় হজ বা ওমরাহ উপলক্ষে গমন করলে জান্নাতুল বাকী ও জান্নাতুল মুয়াল্লায় গমন করতে মন থেকে তাড়িত হই। জান্নাতুল বাকী মসজিদুল নববীর মাত্র শত মিটারের মধ্যে। কিন্তু জান্নাতুল মুয়াল্লা মসজিদুল হারমের উত্তর দিকে ৭/৮ শ’ মিটার দূরত্বে। গরমকালে হজ, তারপরও হজের পরে হেঁটে হেঁটে যাব মনের ভিতর সিদ্ধান্ত পোষণ করে আছি। হেঁটে হেঁটে যাওয়ার মূল কারণ মসজিদুল হারমের ৩/৪ শ’ মিটার পূর্বপাশে আল্লাহর রাসূল (স.)’র জন্মস্থান। ঐ স্থানে একটি লাইব্রেরী হিসাবে দালান রয়েছে। হেঁটে হেঁটে গেলে ঐ জন্মস্থানটির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে যেতে পারব সেই নিয়তে। হজের সপ্তাহখানেক পর আছর জামাতের পরপর আল্লাহর রাসূল (স.)’র পবিত্র জন্মস্থান দেখে জান্নাতুল মুয়াল্লার দিকে যেতে থাকি। সাথে সহযাত্রী বেয়াই মাহবুবুর রহমান। জান্নাতুল মুয়াল্লায় যেয়ারতকালীন আমাদের সাথে যোগ দেয় প্রবাসী আমাদের নাতি মুহাম্মদ সাকিব। যেয়ারতের পর এখান থেকে টেক্সি নিয়ে আমরা ৩ জন জবলে নূরের দিকে চলে যাই। জবলে নূর রাস্তার মধ্যখানে প্রায় ১০/১২ একর এরিয়া নিয়ে দু’টি মিউজিয়াম সাথে নানান দোকানাদি এবং রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে। মিউজিয়াম দু’টি বাদে বাকী সব কিছু সকলের জন্য উন্মুক্ত। দু’টি মিউজিয়াম দেখতে ৩ জনকে টিকেট কাটতে হল জনপ্রতি ৪০ রিয়াল করে। প্রথম মিউজিয়ামটি হল ইতিহাস ভিত্তিক। দ্বিতীয় মিউজিয়াম কোরআন মজীদ ভিত্তিক। ঐ সময় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার একটি গ্রুপও ছিল আমাদের সাথে। প্রথম মিউজিয়ামটি ৩/৪ ব্লকে ভাগ করা। প্রতি ব্লকে ৫০/৬০ জন বসার ব্যবস্থা আছে। অন্ধকার করে আলোর মাধ্যমে ইতিহাস জানান দিচ্ছিল। প্রথম পর্বে হযরত নূহ (আ.)’র আমলে প্লাবন কিভাবে হল, তিনি বড় নৌকা কিভাবে বানালেন, প্লাবন কিভাবে মোকাবেলা করলেন এসব কিছু নিয়ে। এখানে ১০/১৫ মিনিট দেখার পর ২য় ব্লকে নেয়া হল।
এখানে দেখানো হচ্ছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র জালেম নমরুদের সাথে কি কি ঘটল, হযরত হাজেরা (আ.) ও শিশু ইসমাইল (আ.)কে নিয়ে পবিত্র মক্কায় আসলেন তাদেরকে রেখে গেলেন এসব স্মৃতি নিয়ে।
৩য় ব্লকে দেখানো হল, হযরত মুসা (আ.)’র জন্মের পর নীল নদে ভেসে দেয়া হল, ফেরাউনের রাজপ্রাসাদ কর্তৃক এই শিশুর বেলা উঠানো হল। হযরত মুসা (আ.) তাঁর উম্মতগণকে নিয়ে বাহারে কুলজুম (সুয়েজ ও লোহিত সাগর) এর মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম করল, পেছনে পেছনে জালেম ফেরাউন বাহারে কুলজুমে দলবলে নিমজ্জিত হল।
৪র্থ ব্লকে আবরাহা কর্তৃক কাবা শরীফ ধ্বংস করতে আসা, আবাবিল পাখি কর্তৃক তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, ঐ সময়কার কাবা শরীফের কাল্পনিক দৃশ্য প্রদর্শন করা হচ্ছিল।
শেষ পর্বে আল্লাহর রাসূল (স.)’র জন্ম হল, বয়স বাড়ল, জবলে নূরে আসছেন ধ্যানে বসেছেন এবং পবিত্র কুরআন মজীদ ইকরা নাযিল হল তাও প্রদর্শন করা হল।
জবলে নূরের শীর্ষে যেখানে আল্লাহর রাসুল (স.) ধ্যানে বসতেন হুবহু করে এখানে মিউজিয়ামেও পাথর দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে উপরে উঠতে না পারলেও এখানে দেখে অনুমান করা যায়। অতঃপর গাইড আমাদেরকে আয়নার ভিতর দিয়ে জবলে নূর দেখায়ে বর্ণনা দিলেন। বর্ণনার মধ্যে বলেন কর্তৃপক্ষ সিড়ি করে দিয়েছে। ক্যাবলকার এবং রাস্তা নির্মাণের কাজ চলমান তাও জানাল। আয়নার ভিতর দিয়ে অনেকে উঠছেন নামছেন দেখতে পাচ্ছিলাম।
তখন হয়ত বিকেল ৬ টা ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে হবে। আমরা এই মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে টিকেট দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী কোরআন মিউজিয়ামে প্রবেশ করি। সাথে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ানরাও আছে। আমি সৌদি গাইডগণকে বললাম আমাদেরকে তাড়াতাড়ি দেখায়ে দেন আমরা কাবা শরীফে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ব। তারা বলল কোরআন মিউজিয়াম দেখলে কাবা শরীফে নামাজ পড়া যাবে না এখানকার অভ্যন্তরীণ মসজিদে নামাজ পড়তে হবে। আমি বললাম কাবা শরীফে গিয়ে নামাজ পড়ব। ইন্দোনেশিয়ানরা তথাকার মসজিদে নামাজ পড়তে সম্মত।
এতে আমরা এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে দেখতে দেখতে বের হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল কোরআন মাজীদের বিভিন্ন সময়ের নানান ঘটনার ইতিহাস নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। ৭ টা ৫ মিনিটে মাগরিবের আজান। আমরা ৬ টা ২০ মিনিটের দিকে টেঙী নিয়ে রওনা দিয়ে মিসফালাহ ব্রীজে নেমে হেঁটে হেঁটে মাগরিবের নামাজে এসে হাজির হই।
প্রথম মিউজিয়াম আমরা প্রায় ৪০ মিনিট দেখলাম কম্পিউটারের সহায়তা নিয়ে কাল্পনিকভাবে সাজানো ছবি। যেমনটা পবিত্র মদিনা মসজিদে নববীর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দুই মিউজিয়াম সাজানো হয়েছে অনেকটা কাল্পনিক বলা যাবে। তারপরও তাদের আন্তরিকতা আগ্রহকে ধন্যবাদ। এই মিউজিয়াম এর টাইম রাখা আছে সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১২ টা; বিকেল ৪ টা থেকে মধ্যরাত। এখানকার ২০/৩০ টি আরও কম বেশি বিভিন্ন স্বাধের বিভিন্নমানের রেস্টুরেন্ট বিকেল বেলা সৌদিগণ এবং হজ ওমরাহকারীগণকে আকৃষ্ট করতে পারে। তেমনি অনেক দোকানাদিও রয়েছে। আমার মূল গন্তব্য যেহেতু মিউজিয়াম তাই ঐ দিকে দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ হয়নি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।