প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৩ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার চারশত বছর, চট্টগ্রামের কত!

গত দুই কি তিন বছর আগে ঢাকাবাসী ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে ঢাকার চারশত বছর পালন করে। অবিভক্ত বাংলার আরেক বিখ্যাত শহর কলকাতা। কলকাতার জন্ম সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাধ্যমে বলে স্বীকৃত। কলকাতার জন্ম আরও পরে ১৬৯০ সালে। এখন প্রশ্ন জাগে চট্টগ্রামের ইতিহাস কত বছর। চট্টগ্রামের অবস্থান ইতিহাস নিয়ে কম করে হলেও ৪০/৫০টি গ্রন্থ রয়েছে। চট্টগ্রামের বিজ্ঞজন গ্রন্থগুলো লিখে গেছেন। এসব গ্রন্থে যার যার জ্ঞান ধারণা বিবেক মতে চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ করে গেছেন। চট্টগ্রামের নামও রয়েছে ৪০/৫০টি। সম্প্রতি বৃহত্তর চট্টগ্রামের এক বিজ্ঞজন বলেছেন, চট্টগ্রামের ইতিহাস ১২ শত বছর। আমি তার সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত। ভারতবর্ষে চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ভৌগোলিক দিক দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। পূর্বে পাহাড়-পর্বত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর চট্টগ্রামের অনেকটা মধ্যখানে প্রবাহিত যথাযথ প্রশস্ত ও গভীরতা নিয়ে কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলীর উপনদী হালদা। শঙ্খ, মাতামুহুরী নদী এ চট্টগ্রাম অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত। এই অঞ্চলের সমতল ভূমিও উর্বর। এত উর্বর যে কোথাও উল্লেখযোগ্য পরিত্যক্ত জমি আছে বলা যাবে না।

চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে মনে করি সাগরপথে পালতোলা জাহাজ যত হাজার বছর আগে থেকে চলাচল করছে চট্টগ্রামের ইতিহাসের সূচনাও সেই সময় থেকে। পালতোলা জাহাজ দূরযাত্রায় যাত্রাবিরতি অত্যাবশ্যক। ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে আঁকাবাঁকা কর্ণফুলী নদীতে যাত্রাবিরতি সুবিধাজনক। আগে অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, মোহরা কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর তীরে যে শীপইয়ার্ড ছিল এই বিলুপ্ত শিপইয়ার্ড এর উপর গবেষণা; সাথে সাথে শিপইয়ার্ড এর ইতিহাস নিয়েও গবেষণা অত্যাবশ্যক। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সাথে এই শিপইয়ার্ড জড়িত বলে আমার অভিমত।

বিশ্বে সেই প্রাচীনকাল থেকে সাগরপথে দূরযাত্রায় পালতোলা জাহাজের কল্যাণেই এই কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড। যদি কর্ণফুলীতে বিভিন্ন দেশের জাহাজের যাত্রাবিরতি হয়, এই জাহাজের ছোট খাট মেরামতেরও প্রয়োজন পড়ে। বিদেশীদের থাকা-খাওয়া এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য কর্ণফুলীর তীরে যে দোকানাদী প্রতিষ্ঠা করেনি তা বলা যাবে না। এতে স্বভাবতই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে শিপইয়ার্ড। আমরা শিপইয়ার্ড এর তথ্য পাই কয়েক শ’বছর আগের। প্রায় ৪/৫ শত বছরব্যাপী তুর্কি সুলতানরা বিশ্ব শাসন করেছেন। ইউরোপের পূর্বাংশ, আফ্রিকার উত্তরাংশ, এশিয়ার আরব দেশসমূহ তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিশ্বে একক শক্তির অধিকারী তুর্কি সুলতান। তাদের ভয়ে বৃটেন ফ্রান্স তটস্থ থাকত। সেই সময় তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত আলেকজান্দ্রেয়িয়ায় তাদের নিজস্ব শিপইয়ার্ড ছিল। চট্টগ্রাম শিপইয়ার্ডের জাহাজ মজবুত ঠেকসই সস্তা ছিল বিধায় বিশ্বব্যাপী সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এতে তুর্কি সুলতানেরা কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড থেকে শিপ কিনে নিত। সেই সময় হতে চট্টগ্রামের সাথে ইস্তাম্বুলের আলাদা সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।

১৪৫৩ সালে সুলতান ২য় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুল জয় করেন। ইস্তাম্বুল জয় করতে যুদ্ধের কৌশলগত প্রয়োজনে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ২ শত বা কম বেশি শীপ নেয়া হয়েছিল। ঢাকা তুরস্কের জাতীয় দিবসে বর্তমান রাষ্ট্রদূত রামিস সেন তার বক্তব্যে বলেন, সেল যুগ থেকে সুলতানী আমল, সুলতানী আমল থেকে বর্তমান গণতান্ত্রিক তুরস্ক। ইস্তাম্বুল জয়ের পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি প্রবাদ বাক্য জাগরুক হয়। যা আজও হারিয়ে যায়নি। আর তা হল-“চল্লুকর নৌকা পারদি চলে।” অর্থাৎ সেলজুকের নৌকা পাহাড়ের উপর দিয়েও চলতে পারে। এই বাক্যটি শুধুমাত্র চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। অন্যান্য জেলার সাথে সম্পৃক্ত নয়। এতেও ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রাম শিপইয়ার্ডে নির্মিত জাহাজ ছিল না বলা যাবে না। যদি ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামের জাহাজ ব্যবহার হয়ে থাকে তবে চট্টগ্রামের লোক যে ছিল না তাও বলা যাবে না।

এই ত গেল ৫/৭ শত বছর আগের কথা। অপরদিকে ইতিহাসবিদগণ বলছেন, ১৪ শত বছর আগে সাহাবাগণের আগমন হয়েছিল। কেউ কেউ চট্টগ্রামে ২ জন সাহাবীর কবর আছে বলে দাবিও করছে। জানি না কতটুকু সত্য। তবে এখানে যে সাহাবাগণের আগমন হয়েছে সাময়িক অবস্থান হয়েছে এ তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। মহান সাহাবাগণ এখানে যাত্রাবিরতি দিল কেন, তার মূলে প্রাকৃতিক অনুকূল অবস্থান, পরিবেশ তথা কর্ণফুলী নদীতে যাত্রাবিরতিতে নানান সুযোগ-সুবিধা, জাহাজ মেরামতের শিপইয়ার্ড রয়েছে। যদি ১৪ শত বছরের আগে চট্টগ্রামে মহান সাহাবাগণের আগমনের গ্রহণযোগ্যতা পায় তবে সাগরপথে পালতোলা জাহাজের আবিষ্কার হয় চলাচল হয় সেই সময় হতে চট্টগ্রামের ইতিহাস না থাকার কথা নয়। না থাকার কথা নয় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড এর কথা।

উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়াসহ বহু স্থানে তথ্য ভান্ডার রয়েছে। সম্প্রতি সুদূর আমেরিকা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে (University of California Press; Berkely & Los Angels,California; University of California Press Ltd. London, England; First Paperback Printing 1996).

বইটির কথা জানতে পেরে ভাগিনী নিউইয়র্ক বাসী উর্মির সহায়তায় ভাগিনা বধূর মাধ্যমে ইংরেজি বইটি আমার হস্তগত হয়। বইটির নাম The Rise of Islam & the Bengal Frontier-Richard M. Eation-1204-1760. এখানেও চট্টগ্রামের পাশাপাশি শিপইয়ার্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে মোহরা কালুরঘাট এলাকায় শিপইয়ার্ডের কোন অস্তিত্ব নেই। ঐ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে পাইলিং করে ৭০/৮০ ফুট গভীরে গেলেও শক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাই নয় প্রয়োজনের তাগিদে ঐ এলাকায় বৃহত্তর পরিসরে মাটি খনন করলে গাছের শিকড় দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ষোলকবহর, পাথরঘাটা এসব নামের পেছনে চট্টগ্রামের ইতিহাসের অনেক কিছু বহন করছে।

চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে নিজ বিবেচনায় শিপইয়ার্ডের সাথে চট্টগ্রামের ইতিহাস জড়িত বলে আমার ধারণা। আর চট্টগ্রামের ইতিহাস হবে বিশ্বে যখন থেকে পালতোলা জাহাজ এর উৎপত্তি চালু হয়েছে তখন থেকে। আগেও অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, চট্টগ্রামের এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), চট্টগ্রাম কলেজ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কমিটি গঠন করে গবেষণা করা আবশ্যক।

ঢাকা আনন্দ চিত্তে উৎসব মুখর পরিবেশে ৪ শত বছর ফুর্তি পালন করল। কলকাতাও তাদের সাড়ে তিনশো বছর উপলক্ষে চিন্তা করছে। আমরা অতি পুরাতন, ঐতিহ্যের চট্টগ্রাম। কত হাজার বছরের পূর্তি পালন করব তা অস্পষ্ট। গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্টতা আসা আবশ্যক।

কাঠের জাহাজের স্থলে স্টিলবডি আবিষ্কার এবং স্টিলবডির জাহাজ সাগরপথে চালু হয়ে যাওয়ায় কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডের গুরুত্ব হারিয়ে পর্যায়ক্রমে ঐতিহাসিক শিপইয়ার্ড বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কবে থেকে এই শিপইয়ার্ড বিলুপ্ত হল তাও গবেষণার বিষয়।

বিগত ৪১ বছর যাবৎ এ.কে.খানের সুযোগ্য সন্তান জনাব সালাহউদ্দিন কাশেম খান তুরস্কের অনারারি কনসাল জেনারেল। ২০১১ সাল থেকে তাঁর সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তুরস্কের যে কোন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় যোগদান করলে চট্টগ্রাম আসবে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করবে স্বাভাবিক। বাটালি হিলস্থ খান সাহেবের বাসভবনে পরপর ৫ জন রাষ্ট্রদূতের সাথে আমার একাধিক বার সাক্ষাৎ হয়।

কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড থেকে তুর্কি সুলতানগণ কর্তৃক জাহাজ ক্রয়, ইস্তাম্বুল জয় করতে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে শীপ নিয়ে যাওয়া, ঐ জাহাজগুলিতে কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডে নির্মিত জাহাজ নাই তা বলা যাবে না! শুধু তাই নয় ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামের লোকজন নেই তা বলা যাবে না, তা প্রত্যেক রাষ্ট্রদূতকে আলোচনার মাধ্যমে অবগত করি। শুধু তাই নয় ইস্তাম্বুল জয়ের সংবাদ চট্টগ্রাম পৌঁছলে চট্টগ্রামের জনগণের মাঝে চল্লুকর নৌকা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যা চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক এই বাক্য আজও হারিয়ে যায়নি। প্রত্যেক রাষ্ট্রদূত আমার সাথে আলাপ করতে কৌতুহল দীপ্তে আগ্রহ প্রত্যক্ষ করি।

তুরস্কের নৌবাহিনী প্রিগেড শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রামের নৌঘাঁটিতে আসে। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ও প্রিগেডের এডমিরাল এর সৌজন্যে চট্টগ্রামের ১৫/২০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ রাতের খাবারের আয়োজন করেন খান সাহেব। এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রামস্থ নৌবাহিনীর রিয়াল এডমিরাল খন্দকার মিজবাহ-উল-আজিম ও রিয়াল এডমিরাল এস.এম মনিরুজ্জমান, সাথে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম উপস্থিত থাকেন। খান সাহেব ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারসহ আমরা ৩ জন ২ রিয়াল এডমিরালকে বুঝাতে সচেষ্ট থাকি বিলুপ্ত কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী যাতে গবেষণা চালায়। বস্তুত চট্টগ্রামের ইতিহাস কত বছরের তার ওপর গবেষণা আবশ্যক।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মহানগরীর সামগ্রিক উন্নয়ন ভাবনা