বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধারণাতীত উন্নতি লাভ করায় আরবীয়গণের সাথে আমাদের যোগাযোগ যাতায়াত সর্বোপরি তাদের সংস্পর্শে থাকার সুযোগ হয়েছে মাত্র ৩০/৪০ বছরের ব্যবধানে। তিন কারণে আমাদের আরবীগণের প্রতি সম্মান রাখতে হবে।
১. পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি
২. আল্লাহর রাসূল (স.)’র ভাষা আরবি
৩. বেহেশতের ভাষা আরবি
আরবের প্রতি মমতা, সম্মান, ঈমানের অঙ্গ এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কপটতা পরিহার কর। হযরত আনাস (র.) থেকে বর্ণিত। (কানজুল উম্মাল)
আরবের প্রতি সমালোচনাকারীগণ অংশীবাদীদের (ইহুদি, খ্রিস্টান) অন্তর্ভুক্ত। হযরত ওমর উমর (র.) থেকে বর্ণিত। (কানজুল উম্মাল)
বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠ বংশ হল কুরাইশ বংশ। কুরাইশ বংশের ভাষা আরবি। ইসলামে বংশ পরিচয় বংশের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করা আছে। তেমিনভাবে কুরাইশ বংশের কথাও উল্লেখ রয়েছে। কুরাইশ বংশের একটি শাখা হল হাশেমী বংশ। কুরাইশ বংশের এই হাশেমী শাখা থেকে আমাদের রাসূল (স.)’র বংশের আগমন।
একালে আরবীয়গণ আমাদের দেশে আসতেছেন না বলা যাবে। হয়ত ঢাকায় আরব দেশগুলোর দূতাবাস এবং কোন প্রবাসী বা কোন মাদ্রাসার আমন্ত্রণে কোন কোন সময় হয়ত দু’য়েক জন আরবি আসছেন যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের দেশের কোটির উপরে নর–নারী আরব রাষ্ট্রসমূহে কর্মরত। তৎমধ্যে ৬টি উপসাগরীয় রাজতন্ত্রীয় দেশ অন্যতম বলা যাবে। প্রবাসীরা এই সব দেশে টাকা উপার্জন করছে আরবীয়গণের সংস্পর্শে থেকে। কেউ বা আরবীয়গণের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছে, আবার কেউ আরবীয়গণের ডকুমেন্ট ব্যবহার করে সম্মতি সাপেক্ষে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। এতে আরবীয়গণের আচার–আচরণ ভাল মন্দ আমাদের দেশীয় প্রবাসীরা বাস্তব অবলোকন করতেছেন। মানুষ মনুষ্যত্বের ঊর্ধ্বে নয়। আরবীয়গণও মানুষ, তাদের মধ্যেও ভালো মন্দ থাকবে। কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসম্মান তথা অবর্তমানেও কোন নোংরা অসভ্য আচরণ করা যাবে না। তাদের বড় সৌভাগ্য তারা আরবীয়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। তা আমাদের বুঝতে হবে মানতে হবে। তারা আমাদের দেশে আসছে না আমরাই টাকা উপার্জনের জন্য তাদের দেশে যাচ্ছি।
একালে অনেক প্রবাসী অপরাধে অনৈতিক কাজে লিপ্ত। যা ১৯৭০/৮০ দশকে ছিল না। আমাদের দেশ থেকে শুধুমাত্র হজ্বের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাওয়া হত। কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে ঢাকায় সৌদি আরব দূতাবাস খোলার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে স্রোতের মত সৌদি আরবে লোকজন যাওয়া শুরু টাকা রোজগারের জন্য। সৌদি আরবের সমান্তরালে উপসাগরীয় অপর ৫ টি রাজতন্ত্রীয় দেশ দুবাই আবুধাবীসহ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, কুয়েতে ব্যাপকভাবে আমাদের দেশের লোকজন যাওয়া শুরু করে টাকা রোজগার করতে। পরবর্তীতে আরও যোগ হয় লিবিয়া, ইরাক, জর্ডান, লেবাননসহ অন্যান্য আরব দেশ।
আরব দেশসমূহের মধ্যে এমন দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে আমাদের বাংলাদেশীরা টাকা রোজগারের জন্য তথায় কর্মরত নেই। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশের প্রতিফলন দেশের প্রবাসীরা সেসব আরব দেশেও অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, গত ক’বছর আগে মসজিদুল হারমে যোহরের সময় দাম্মাম থেকে হজ্ব করতে আসা ৩ সৌদির সাক্ষাত হয়। তৎমধ্যে একজন ডাক্তার। তিনি দুঃখ করে আমাকে বললেন, বাংলাদেশীরা এখানে এসে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। বাংলাদেশীদের অপরাধ নিয়ে সেসব দেশের টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে।
একজন সম্মানিত পবিত্র মদিনাবাসী তাঁর বাসভবনে দুপুরের খাবারের দাওয়াত দেন। অবশ্য মসজিদে নববীতে তাঁর সাথে একাধিক বার সাক্ষাত হয়।
এ প্রচুর অর্থ সম্পদশালী মাদানী দুঃখ করে বলেন, তিনি একাধিক বার বাংলাদেশে এসেছেন আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে। যে বাংলাদেশীর মাধ্যমে এসেছেন তাঁর মাধ্যমে, দেশে যার মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন উভয়ের মাধ্যমে তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
ক’বছর আগের কথা সম্ভবত কুয়েতে। সেই দেশের একজন আরবীয় শেখ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে নানান পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ডাক্তারেরা বুঝতে পেরেছেন মানুষের প্রশ্রাব খাওয়ার কারণে এই অসুখ হয়েছে। এতে তার কাছে চাকুরী করা প্রবাসীদের আটক করে। প্রবাসী বলতে তারা বাংলাদেশী। আটকে জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে আরবী শেখ বা কফিলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তারা পানির স্থলে বারে বারে তাদের প্রশ্রাব খাওয়ায়ছে। বিষয়টি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রচার লাভ করে।
আরব রাষ্ট্রসমূহে সবচাইতে বেশি প্রবাসী সৌদি আরবে। সৌদি সরকার চাচ্ছে প্রবাসীরা চাকুরীজীবি হিসেবে সৌদিদের কর্মরত থাকুক। সৌদিরা নিজ মালিকানায় ব্যবসা করবে, বিভিন্ন কোম্পানীর মালিক হিসেবে কর্ণধার হয়ে থাকবে। প্রবাসীরা শুধু সৌদিদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে চাকুরীজীবি হিসেবে। বাস্তবতা নিরিখে বাংলাদেশী প্রবাসীগণের মধ্যে একটি অংশ সৌদি কফিলের নাম ব্যবহার করে নিজেরাই নানাবিধ ব্যবসা পরিচালনা করছে। যা সৌদি আইন মতে সম্পূর্ণ অবৈধ। এখন বিশ্ব প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। প্রবাসীদের ব্যাংক হিসাব তাদের নজরে, তেমনিভাবে কফিলদেরও নজরে। নিজের চাকুরীর টাকার ব্যাংক হিসাব বাদে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যাংক হিসাব কফিলের নামে। এতে প্রবাসীর লাভ ক্ষতি কফিল যেমনি দেখছেন, তেমনি সৌদি কর্তৃপক্ষও দেখছেন। এতে প্রবাসীরা বড় ধরনের লাভবান হলে কফিল লভ্যাংশের ভাগ চাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
মোটামুটি শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন বাদে যারা ব্যবসা–বাণিজ্যসহ ভাল কর্মকান্ডে জড়িত তাদের সাথে কফিলের এবং সৌদি কর্তৃপক্ষের সর্ম্পকের অবনতি হওয়া অনেকটা স্বাভাবিক।
প্রবাসীরা দেশে আসলে অনেকে অন্যদের সাথে আলাপে আরবীয়গণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হেয় করে কথা বলে। আমাদের ভাবতে হবে আমাদের সন্তানেরাই আরবে যাচ্ছে টাকা রোজগারের জন্য। আমাদের সরকারের যথাযথ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তৎপর বিভিন্ন আরব দেশে লোক পাঠানোর জন্য। আরব রাষ্ট্রগুলো আমাদের দেশের লোক পাওয়ার জন্য মুখাপেক্ষী নয়। বিশ্বের আরও অনেক দেশ রয়েছে তাদের দেশে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার জন্য। আমাদের বুঝতে হবে আরবীয়গণের সম্মান ধর্ম মতে জড়িত গ্রহণযোগ্য বিবেচিত।
আগেই উল্লেখ করেছি। তিন কারণে আরবীয়গণকে সম্মান করা আমাদের দায়িত্ব। যথা–
১. পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি
২. আল্লাহর রাসূল (স.)’র ভাষা আরবি
৩. বেহেশতের ভাষা আরবি
আমরা যে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি যা ঈমানের পর প্রধান ফরজ। আরবি না জানলে তো নামাজই হবে না।
১৯৭০ এর দশক থেকে যখন আমাদের দেশ থেকে আরব রাষ্ট্রসমূহে প্রবাস জীবন শুরু হয় তা অনেকটা ১৯৯০,১৯৯৫ সর্বশেষ হয়ত ২০০০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশীয় প্রবাসীদের নৈতিকতা তত খারাপ ছিল না। আরবীয়গণের কাছেও মুসলিম দেশের গরীবেরা টাকা রোজগারের জন্য এসেছেন বিবেচনায় মিসকিন বলে আদর সোহাগ স্নেহ কাজ করছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের প্রবাসীদের মধ্যে বড় অংশ অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায়। ফলে একালে বাংলাদেশী বলে অপরাধ জগতের মানুষ নোংরা জগতের মানুষ হিসেবে তাচ্ছিল্যভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রবাসীদের বিগত ৫০ বছরের মূল্যায়ন করলে প্রথম ২৫ বছর আরবীয়গণের কাছে আমাদের প্রবাসীদের প্রতি আদর স্নেহ সোহাগ কাজ করছিল। পরবর্তী ২৫ বছর তথা বর্তমান অবস্থান ভিন্ন। আমাদের প্রতি তাদের সহমর্মিতা উঠে এখন ঘৃণা, তুচ্ছ্য তাচ্ছিল্য মনোভাব ফুটে উঠেছে দিন দিন। আবারও বলছি, আমাদের দেশীয়রাই নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরব রাষ্ট্রেসমূহে টাকা রোজগার করতে। অতএব আমাদের দায়িত্ব হবে আরবীয়গণের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান রাখা। আরবীয়গণের পক্ষ থেকে কোন অযৌক্তিক অমানবিক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে আমাদের প্রবাসীদের দায়িত্ব হবে শালীনতা রক্ষা করে তা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করা। অবশ্যই শালীনতা রক্ষা করতে হবে। আরবীয়গণের অবর্তমানে দেশে এসে তাদের সমালোচনা করলে ধর্মীয়ভাবে পরিণতি ভোগ করতে হবে।
অতএব আশা করব, প্রবাসীরা আরবীয়গণের প্রতি সম্মান দেখাবেন শ্রদ্ধা রাখবেন তাদের দ্বারা কোন অবিবেচনা বা অনৈতিক বা অগ্রহণযোগ্য কিছু হলে তা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা শালীনতা বজায় রেখে সমাধানের চেষ্টা করবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট