হজ্বযাত্রী দেশ থেকে রওনা হয়ে জেদ্দা বা পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরে নামবে। ওমরাহ এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আপনি যদি হজ্ব বা ওমরাহযাত্রী জেদ্দা বিমান বন্দর নামেন তাহলে জেদ্দা বিমান বন্দরে নামার ঘণ্টাখানেক আগে বিমানের ভিতর মাইকে ঘোষণা শুনতে পাবেন আর ২৫/৩০ মিনিট পর বিমান মিকাত অতিক্রম করবে। অতএব যাত্রীরা যাতে এহরাম পরিধান করে নেয়। মিকাতের এতই যে গুরুত্ব। আপনি যদি পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরে নামেন তাহলে সড়কপথে পবিত্র মক্কা আসতে যুলহুলায়ফা মিকাত বা মিকাতের আগে থেকে এহরাম পরিধান করতে হবে। অর্থাৎ পবিত্র কাবার এত বিশাল মর্যাদা যে, তথায় পৌঁছতে দেড় শ, দুই শত বা চার শত কি.মি আগে থেকে এই খানায়ে কাবা পৌঁছার বিশেষ পোশাক এহরাম পরিধান করে নিতে হবে।
হজ্ব ও ওমরাহকারী উভয় মহান আল্লাহ পাকের আমন্ত্রিত মেহমান। তাদেরকে বাংলাদেশ বা যে কোন দেশ থেকে পবিত্র মক্কায় গমন করতে অবশ্যই মিকাত অতিক্রম করতে হবে। মিকাত অতিক্রম করার আগে এহরাম বাঁধা বাধ্যতামূলক।
ইসলামের পরিভাষায় মিকাত বলতে এমন নির্দিষ্ট কতিপয় জায়গাকে বুঝায়, দূরাঞ্চল থেকে পবিত্র কাবা গমেনচ্ছুক ব্যক্তিগণের হজ্ব বা ওমরাহর এহরাম ব্যতীত ঐ জায়গাগুলো বা তার বরাবর রেখা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। কেউ ইচ্ছা করলে মিকাতে পৌঁছার আগেই যে কোন স্থান থেকে এমনকি নিজের ঘর থেকেও এহরাম বাঁধতে পারে। কিন্তু মিকাতে পৌঁছে গেলে অবশ্যই এহরাম বাঁধতে হবে। বিনা এহরামে মিকাত অতিক্রম করলে দম (কাফফারা স্বরূপ পশু কোরবানি) ওয়াজিব হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলমানগণের জন্য নবী পাক (স.) ৫টি মিকাত নির্ধারিত করে দিয়েছেন।
যুলহুলায়ফা বা বীরে আলী: ইহা পবিত্র মদিনাবাসী ও এইপথে আগতগণের মিকাত। ইহা মদিনা মুনাওয়ারা মূল শহর থেকে মাত্র ১০–১২ কি.মি দূরত্বে। এ মিকাত থেকে পবিত্র মক্কা মোকাররমার দূরত্ব ৪১০ কি.মি।
জুহফা: বর্তমান রাবেক বন্দর শহরের নিকটে। ইহা মিশর ও ঐ পথে আগতগণের মিকাত। এখান থেকে মক্কা মোকাররমার দূরত্ব প্রায় ১৮০ কি.মি।
যাতে ইরক: ইরাকবাসী ও ঐ দিক থেকে আগতগণের মিকাত। এর অবস্থান তায়েফ থেকে কিছুটা দূরত্বে। বর্তমানে যাতায়াত কিছুটা দুর্গম। যেহেতু বর্তমান সড়ক মহাসড়ক অন্য দিক দিয়ে নির্মিত। ফলে আমার অন্য চার মিকাত থেকে ওমরাহ করার সৌভাগ্য হলেও যাতায়াত প্রতিকূলতায় এ মিকাতে গমন করে ওমরাহ করা সম্ভব হয় নিই।
কারনুল মানাযিল: এ মিকাতকে করণও বলে। ইহা নজ্দ, কুয়েত, বাহরাইন, কাতারসহ সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয়গণের মিকাত। তায়েফ থেকে মক্কা মোকাররমায় আসতে প্রসিদ্ধ দু’রাস্তার একটিতে প্রায় ১০–১৫ কি.মি দূরত্বে একটিতে পড়ে। মক্কা মোকাররমা থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৯০ কি.মি। এই মিকাতের সমান্তরালে আরেক বড় রাস্তারও সৌদি সরকার চিহ্নিত করে মসজিদ এবং এহরামের প্রস্তুতিতে ওযু গোসলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এর নামকরণ করা হয় ওয়াদী মেহরম। অতএব এখান থেকেও এহরাম বাঁধতে পারবে।
ইয়ালামলাম: এই মিকাত ইয়েমেন, বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের এবং ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়াসহ পূর্বাঞ্চলীয়গণের সাগরপথে গমনকারীগণের মিকাত। ইহা মক্কা মোকাররমা থেকে অনেকটা দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রায় ১২০ কি.মি দূরত্বে একটি পাহাড়ে। সৌদি সরকার সেখানে গমন করা কষ্টসাধ্য হবে মনে করে সমান্তরাল রেখা বরাবর প্রায় ১ কি.মি দূরত্বে সমতলে মসজিদ, এহরাম বাঁধার সুযোগ সুবিধা সমেত যাবতীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছেন।
আপনি যদি চট্টগ্রাম বা ঢাকা বিমান বন্দর হয়ে সরাসরি পবিত্র মদিনা যান তবে বিমানের অভ্যন্তরে মিকাত প্রসঙ্গে ঘোষণা শুনতে পাবেন না। যদি আপনি জেদ্দা যান তখন বাংলাদেশ বিমান, সৌদি এয়ারলাইন্স বা যে কোন এয়ারলাইন্স জেদ্দা পৌঁছার ঘণ্টাখানেক আগে ফ্লাইটের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক বার ঘোষণা দেয়া হবে প্রায় ২৫/৩০ মিনিট পর ফ্লাইট মিকাত অতিক্রম করবে। কাজেই এহরাম বাঁধার জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। জেদ্দা হয়ে পবিত্র মক্কা গেলে ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে ফ্লাইটে উঠার আগে এহরাম বাঁধা উত্তম।
বর্তমানে বাংলাদেশের হজ্ব ও ওমরাহকারীগণ একমাত্র আকাশপথেই সৌদি আরব গমন করছে। অতএব আমরা বাংলাদেশীগণের মিকাত হিসেবেগণ্য হবে কারনুল মানাযিল বা যাতে ইরক।
মিকাতের ভিতর কিন্তু হুদুদে হারমের বাহিরের এরিয়াকে হিল্ল বলে। হুদুদ অর্থ সীমানা অর্থাৎ হারমের সীমানা। হারম এরিয়ার মর্তবার পর এই হিল্লেরও গুরুত্ব তথা মর্তবা রয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা হজ্ব বা ওমরাহ করতে গেলে নিজের ঘর থেকে এহরাম বাঁধা উত্তম।
হুদুদে হারম তথা হারম শরীফের পরিধি হচ্ছে মদিনা মুনাওয়ারার দিকে মসজিদে আয়েশা বা তানঈম। জেদ্দার দিকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরত্বে হুদায়বিয়ার সন্ধির স্থান যাকে সুমাইসীয়া বা সুমায়সীয়া বলে। ইয়েমেনের দিকে প্রায় ১০ কি.মি দূরত্বে ইযাআতে লবণ নামক স্থান। তায়েফের দিকে আরাফাতের আগে প্রায় ১৬ কি.মি দূরত্বে জুরানা বা জেরানা। তবে সম্প্রতি সৌদি সরকার এ হুদুদে হারমের সীমানাকে মিকাত লিখছে। পবিত্র মক্কা বিজয়ের পর নবী পাক (স.) হুনায়নে ছোটখাটো অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তথা হতে ফিরবার পথে এ জুরানা বা জেরানা থেকে এহরাম বেঁধে ছিলেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়।
মক্কা মোকাররমার চারদিকে নির্দিষ্ট সীমারেখার এরিয়াকে হারম বলা হয়ে থাকে। হযরত জিব্রাইল (আ.) হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে নিয়ে ঐ স্থান সমূহের অবগতকরণ তথা পরিচয় করিয়ে দেন। অতঃপর নবী পাক (স.) এ চিহ্ন সমূহ করে দেন। পরে আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (র.)’র খেলাফত আমলসহ পরবর্তীতে এসব সীমানা চিহ্নগুলো পুনঃ নির্মাণ করা হয়। এখানে রয়েছে এহরাম বাঁধার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা।
হুদুদে হারম তথা হারমের সীমানার ভিতর স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার বা হত্যা করা, ধরা, তাড়ানো, বৃক্ষ গাছ ইত্যাদি কর্তন হারাম। হজ্ব বা ওমরাহকারী অন্য কোন প্রয়োজনের তাগিদে হারমের সীমানার ভিতর প্রবেশ করতে হলে মনে রাখতে হবে এখন আপনি আল্লাহর খাস এলাকার পরিধির মধ্যে প্রবেশ করছেন। অতএব আদব, বিনয়, পবিত্রতা সবকিছু বজায় রাখতে ও থাকতে হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র.) বলেন নবী রাসূলগণ যখন হারমের সীমানায় প্রবেশ করতেন তখন খালি পায়ে চলাফেরা করতেন এবং খালি পায়ে হজ্বের আহকাম সমূহ আদায় করতেন।
এই কথা সত্য যে, মানুষ যদি নিজের মাথার উপর ভর দিয়েও পবিত্র হারম এরিয়ায় চলাফেরা করেন তবুও আদবের হক আদায় করতে সক্ষম নয়। কাজেই যতটুকু সম্ভব এই পবিত্র হারম এরিয়ার জমিনের প্রতি হজ্ব ওমরাহ ও একামাওয়ালাদের সাবধান থাকা অত্যাবশ্যক। আদব দেয়া যখন কঠিন তথা সম্ভবের বাহিরে অন্ততঃ বেয়াদবী যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা অত্যাবশ্যক।
উল্লেখ্য গবেষকগণের মতে হারম এরিয়া আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। জাহেলী যুগেও এ হারমকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হত। আর হজ্ব ও ওমরাহকারীগণের জন্য মিকাতের প্রবর্তন করেন স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (স.)।
এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.) নিজেই মিকাতের সীমানা নির্ধারণ করে দেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ)
অতএব হজ্ব ওমরাহকারীগণের মিকাতের মর্যাদা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট।