প্রবাহ

হযরত মালেক শাহ (রহ.)'র অন্যতম কারামত চট্টগ্রামে জানাযা

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:০১ পূর্বাহ্ণ

তাসাউফ জগতের অন্যতম প্রাণ পুরুষ সুফি দরবেশ হযরত শাহ মাওলানা আবদুল মালেক (রহ.) প্রকাশ কুতুবদিয়া হযরত মালেক শাহ। ছাত্র জীবন থেকে এ মহান দরবেশের উপর অনেক কিছু জেনে আসছিলাম। এও জানতাম, তিনি আজমগড়ী সিলসিলার অন্যতম দরবেশ। তাঁর পরবর্তী জীবন কুতুবদিয়া কেন্দ্রিক জানতাম। সংবাদপত্রে জেনে আসছিলাম তিনি চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করছেন চিকিৎসায় আছেন।

২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জানলাম তিনি চট্টগ্রাম শহরে ইন্তেকাল করেছেন। এও জানলাম পরদিন সকাল ৯ টায় প্যারেড ময়দানে তাঁর জানাযা হবে। কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় থাকি। এখান থেকে প্যারেড মাঠের দূরত্ব ৭/৮ শত মিটার হতে পারে। আবাসিক এলাকার ভিতর থেকে রাস্তার দিকে আসতেই দেখি বড় রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি। এই সময় রাস্তায় এত গাড়ি থাকার কথা নয়। তখন প্যারেড ময়দানের দিকে হাঁটতে শুরু করি। অলি খাঁ মসজিদ পার হয়ে দক্ষিণ দিকে যেতেই জানাযা সমাগমের ব্যাপকতা অনুভব করতে থাকি। যত সামনের দিকে যাই মানুষ আর মানুষ।

বিশাল এরিয়া নিয়ে প্যারেড ময়দান তখন অনেকটা সমাগমে পূর্ণ। লাশের খাটিয়া প্যারেড ময়দানের একদম পশ্চিম দিকে রাখা আছে। এত বেশি সমাগম যে জানাযার শৃংখলা রক্ষা করাটা কঠিন হচ্ছে। প্যারেডের ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মাঠের চতুর্দিকে লোকে লোকারণ্য। বিষয়টি আমার বুঝে আসছে না।

এই মহান সুফি দরবেশ ১৯৬০ সাল থেকে কুতুবদিয়ায় অবস্থান করছেন। চট্টগ্রাম শহরের সাথে তাঁর তেমন আসাযাওয়া আসে বলে শুনিনি। তিনি যে একজন ফানাহ ফিল্লাহ সুফি দরবেশ তা আমার দিলে জাগরুক থাকলেও ১৯৬০ সাল থেকে তাঁর অবস্থান যেহেতু কুতুবদিয়া কেন্দ্রিক অতএব জানাযার প্যারেড ময়দানের সর্বোচ্চ তিন ভাগের এক ভাগ পূর্ণ হতে পারে। হয়ত সর্বোচ্চ প্যারেড ময়দানের অর্ধেক পূর্ণ হতে পারে। কিন্তু জানাযায় এসে বিশাল সমাগম আমাকে ভাবিয়ে তুলে। জানাযায় শতভাগ ইনসান হতে পারে না। এই মহান অলি ফানাহ ফিল্লাহ জগতে বিচরণকারী মহান দরবেশের জানাযা পড়তে জিন ফেরেশতার আগমন ঘটেছে এতে ইতস্ততা নেই। জানাযার পর নাকি ওখানে আরও একটি জানাযা হবে। অতঃপর তাঁর পবিত্র লাশ কর্ণফুলী নদী হয়ে সাগর পথে কুতুবদিয়া নিয়ে যাবে। কুতুবদিয়ার জানাযায় ব্যাপক সমাগম হবে আমার বিশ্বাস, যেহেতু তিনি ১৯৬০ সাল থেকে কুতুবদিয়া অবস্থান করেন তথায় ব্যাপক সমাগম হওয়া স্বাভাবিক।

আল্লাহ পাকের মহান অলিগণের কারামত যে সত্য তা ইসলাম ধর্ম মতে গ্রহণযোগ্য। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেনজেনে রেখো, (কিয়ামতের দিন) নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলীদের কোনো ভয় থাকবে না। না থাকবে তাঁদের কোনো চিন্তা ও আশঙ্কা। তাঁরা হচ্ছেন খাঁটি ঈমানদার এবং সত্যিকার আল্লাহভীরু। তাঁদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুসংবাদ দুনিয়া এবং আখিরাতেও। আল্লাহ্‌ তা‘আলার কথায় কোন হেরফের নেই। এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত সফলতা’। (ইউনুস : ৬২৬৪), হাদীস শরীফেও মহান আল্লাহ পাকের অলি দরবেশগণের কারামতের কথা উল্লেখ রয়েছে।

শাহ মাওলানা আবদুল মালেক (রহ.) ১৯১১ সালের ২১ জুলাই শুক্রবার কুতুবদিয়া নিজ পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশুকাল থেকেই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা এবং দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে জ্ঞান লাভে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি ছাত্র জীবনে হালিশহর হাফেজ মুনির উদ্দিন (রহ)’র সান্নিধ্য লাভ করেন। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তাসাউফ শিক্ষায়ও তিনি উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করতে থাকেন। এতে এ মহান দরবেশ এত উচ্চতায় পৌঁছে যান তাঁর কশফের শক্তি এত বিশাল ব্যাপক যে মনে হয় দুনিয়া তাঁর কাছে এক ফোঁটা পানির মত। তিনি ছিলেন অসাধারণ সাহসী।

তাঁর দাদা পীর ভারতে উত্তর প্রদেশের হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান প্রকাশ আজমগড়ী হযরত ১৯০০১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলে তরিকতের সফর করেন। অতঃপর ১৬ বছর বিরতি দিয়ে সর্বশেষ ১৯৫৫ সালে অতি বার্ধক্যে চট্টগ্রাম সফর করে গেছেন। ১৯৩৯ সালের বা তার ক’বছর আগে আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম সফর করে ট্রেনে বিদায় নেওয়ার সময় হযরত মালেক শাহ (রহ.) তাঁর দাদা পীরের ট্রেন আটকিয়ে দিয়ে ছিলেন। আধ্যাত্মিক শক্তির সাথে সাহসও না থাকলে তা সম্ভব হবার নয়। এই ঘটনাটি অনেকের জানা থাকার কথা। আমারও সংবাদপত্র সহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এই ঘটনাটি লিখা হয়।

হালিশহরের হাফেজ ছাহেব হুজুরের ছাহেবজাদার সাথে আমার খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কাজী শাহ মাওলানা সিরাজুল মোস্তফা (রহ.)’র সাথে বারে বারে মোলাকাত হত। কিন্তু তাঁর মহান পিতার তরিকত বিষয় নিয়ে তেমন আলোচনা হত না। তাঁর ইন্তেকালে জানাযা পড়ার সুযোগ হয়।

পরবর্তীতে হাফেজ ছাহেব হুজুরের ছোট ছাহেবজাদা হযরত ছাবের ছাহেবের সাথে আমার অত্যধিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হাফেজ ছাহেব হুজুরের যেয়ারতে গেলে ছাবের ছাহেবের ২য় তলায় চানাস্তা অবধারিত থাকত। কেন জানি তিনি আজমগড়ী হযরত, তাঁর মহান পিতার তরিকত জগৎ বিষয়ে আমাকে অবগত করাতে তৎপর লক্ষ্য করি।

১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবনে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হবার সৌভাগ্য হয়। তা হযরত ছাবের ছাহেবের শতভাগ জানা। তারপরও তিনি আজমগড়ী সিলসিলা তাঁর মহান পিতার সিলসিলার উপর আমাকে ধারণা দিতে থাকেন। হয়ত লেখালেখির জগতে আছি আমার দ্বারা এই হালিশহর হুজুরেরও ন্যূনতম কিছু খেদমত হতে পারে। বাস্তবতা নিরিখেও তাই হচ্ছে। বিগত ক’বছর থেকে রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দিকে হালিশহরের হাফেজ ছাহেব হুজুরের উপর সংবাদপত্রে লিখার সুযোগ হয়ে আসছে।

হযরত ছাবের শাহ কুতুবদিয়া হযরত মালেক শাহ এর উপরও একাধিক ধারণা দেন। তৎমধ্যে একটি হল ১৯৫৫ সালে আজমগড়ী হযরত অতি বার্ধক্যে সপ্তাহখানেকের জন্য চট্টগ্রাম সফরে আসলে ৩ কি ৪ রাত হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়িতে অবস্থান করেন। কয়েক জন ভক্ত নিয়ে হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ির নিকটে অবস্থান নিয়েছিলেন হযরত মালেক শাহ (রহ.)। ছাবের ছাহেব টাইমে টাইমে খাবার পাঠাতেন। হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ি সেই সময় লোকে লোকারণ্য থাকত। এই সময় তথায় অবস্থান করা গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা, কুতুবদিয়া মালেক শাহ সহ অতি উচ্চ মর্যাদার সম্মানীয় ব্যক্তিত্বগণকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে অপারগ ছিলেন বলে আমার নিকট একাধিক বার ব্যক্ত করেন ছাবের ছাহেব।

কেন জানি দিলে টানে কুতুবদিয়া তাঁর যেয়ারতে যেতে। বৃদ্ধ বয়স কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিতে হবে।

বিশ্বখ্যাত মহান অলি সুফি কবি সাহিত্যিক দার্শনিক হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ.)। ইরানের নিশাপুরে একাধিক ইমাম, সুফি, কবি, সাহিত্যিক শায়িত। হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ.) তৎমধ্যে অন্যতম। তিনি সর্বমহলে পঠিত অনেক কিতাব রচনা করে গেছেন। এরই মধ্যে ‘তাযকেরাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থ রচনা করে খুশিতে আত্মহারা হয়ে অভিভূত হন। অনুভূতি ব্যক্ত করেন। এতে তিনি মহান ইমাম, সুফি, অলি, দরবেশগণের জীবনী লিখলে আলোচনা পর্যালোচনা করলে কি কি কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা উল্লেখ করে যান। তাতে তিনি হযরত জুনাইদ বোগদাদী (রহ.) সহ আরও বিশ্বখ্যাত একাধিক অলি দরবেশের অনুভূতি উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালে তৃতীয়বার ইরান গমন করলে নিশাপুরে এসে তাঁর যেয়ারত করার সৌভাগ্য হয়। অপরদিকে ১৯৯৭ সালে সপ্তাহখানেকের জন্য ইরাক সফরকালে বাগদাদে হযরত জুনাইদ বোগদাদী (রহ.)’র যেয়ারত করা হয়। হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ.)’র অনুভূতিকে ১৫ পয়েন্টে পৃথক পৃথক ভাবে ভাগ করে উল্লেখ করা আছে। আমার রচিত পারস্য থেকে ইরান (বর্ধিত সংস্করণ), ইমাম অলি দরবেশের দেশ উজবেকিস্তান, হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী উক্ত তিনটি গ্রন্থের যে কোন একটিতে উক্ত ১৫ পয়েন্ট দেখা যাবে। বস্তুত হযরত শাহ মাওলানা আবদুল মালেক (রহ.) বিশ্বখ্যাত একজন অলি দরবেশ । তাঁর কারণে আজ কুতুবদিয়া গর্বিত, গর্বিত চট্টগ্রাম অঞ্চল। তাঁর কারণে বিশ্বব্যাপী কুতুবদিয়া পরিচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহেলাল হাফিজ : দুঃখের আরেক নাম
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৩