মুক্ত ইসলামের প্রথম মসজিদ–এ–কুবা। যার অবস্থান মসজিদে নববী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে কিছুটা পশ্চিমে। এই মসজিদ–এ–কুবাকে সৌদি সরকার অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে সাজাচ্ছেন। দৈনিক হাজার হাজার হজ্ব ওমরাহকারী বরকতময় এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসছেন। সেই লক্ষে তাদের সুযোগ–সুবিধা দিতে সৌদি কর্তৃপক্ষ তৎপর। যেহেতু নবী পাক (স.)’র নিকট মসজিদে নববীর পর মসজিদ–এ–কুবার গুরুত্ব। তিনি সাহাবাগণের সহযোগিতা নিয়ে নিজ হাতে মসজিদ–এ–কুবা নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদে সব সময় নামাজীর সমাগম থাকে। কর্তৃপক্ষের কল্যাণে একাধিক গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা, সুন্দর পরিচ্ছন্ন ওয়াশ রুম ব্যবস্থা, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট ইত্যাদি নানান সুযোগ সুবিধায় ভরপুর।
সম্প্রতি সংযোজন করা হয়েছে মসজিদে নববী–মসজিদ–এ–কুবা পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য পৃথক রাস্তা। মসজিদে নববীর দক্ষিণ–পশ্চিম কোণা তথা মসজিদে গামামার পূর্ব পাশ দিয়ে এই পায়ে হাঁটার রাস্তাটি শুরু। রাস্তাটি ঠিক সোজা গিয়ে মসজিদ–এ–কুবার উত্তরপাশে সামান্য পশ্চিমে শেষ হয়। এই রাস্তা দিয়ে স্রোতের মত হজ্ব ওমরাহকারী এবং স্থানীয় প্রবাসীরা চলাচল করছে। এই রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য দোকান রেস্টুরেন্ট। সম্প্রতি এই রাস্তা দিয়ে চালু করা হয়েছে বেটারী চালিত টেক্সী। ৮/১০ জন ধারণ ক্ষমতার বেটারী চালিত এ টেক্সী মসজিদে নববী–মসজিদ–এ–কুবা আনা নেয়া করাচ্ছে। টেক্সীর ভাড়া জন প্রতি ১০ রিয়াল। এই রাস্তার দু’পাশে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করবে। মধ্যখানে বেটারী চালিত গাড়ি তথা ইলেকট্রনিক গাড়ি।
বাদশাহ ফাহাদের আমলে ১৯৮৫ সালে মসজিদে নববী বিশালভাবে সম্প্রসারণ কাজ শুরু করে। সেই সময় মসজিদ–এ–কুবা মসজিদে কিবলাতাইন যুলহুলায়ফা মিকাত মসজিদসহ অনেক মসজিদ পুনঃ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে হজ্ব ওমরাহকারীরা এই মসজিদগুলো প্রত্যক্ষ করছে। বর্তমানকালে মসজিদ–এ–কুবা কর্তৃপক্ষ নানান সুযোগ–সুবিধা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
হজ্ব ওমরাহকারীরা পবিত্র মদিনায় গমন করলে কাফেলাওয়ালা তার নিয়ন্ত্রিত যেয়ারতকারীদের একদিন সকালে হোটেলে থেকে চার স্থানে ঘুরিয়ে আনেন। যথা– মসজিদ–এ–কুবা, মসজিদে কিবলাতাইন, খন্দকের যুদ্ধের স্থান তথা সাত মসজিদ এবং উহুদের শহীদগণের যেয়ারত। আজ থেকে ৩০/৪০ বছর আগে পবিত্র মদিনায় আরও অতিরিক্ত ৪/৫ স্থানে দর্শনের জন্য যাওয়া যেত। যুগের সময়ের অবস্থায় তা আর যাওয়ার অবস্থাও নেই, ব্যবস্থাও নেই।
নবী পাক (স.) এই মসজিদকে খুব ভালোবাসতেন, তিনি বলেন এই মসজিদে যে কেউ ২ রাকাত নামাজ পড়লে তিনি এক ওমরাহর সওয়াব পাবেন। মসজিদ–এ–কুবার কথা পবিত্র কুরআন মাজীদে এসেছে। সূরা তাওবায় আল্লাহ পাক বলেছেন, আপনি কখনও সেখানে দাঁড়াবেন না, তবে যে মসজিদের ভিত্তি রাখা হয়েছে তাকওয়ার উপর প্রথম দিন থেকে, সেটিই আপনার দাঁড়াবার যোগ্য স্থান। সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতাকে ভালোবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালোবাসেন।
মসজিদ–এ–কুবাকে নিয়ে বুখারী শরীফে ৯টি, মুসলিম শরীফে ১৩ টি, আবু দাউদ শরীফে ২ টি হাদীস শরীফ রয়েছে। পবিত্র মদিনায় ওজু করে মসজিদ–এ–কুবায় গিয়ে ২ রাকাত নামাজ পড়লে এক ওমরাহর সওয়াব পাওয়া যায়। অবশ্য এখানে কোনো কোনো হাদীস শরীফে শনিবারের কথা উল্লেখ রয়েছে। নবী পাক (স.) পবিত্র মদিনা থেকে পায়ে হেঁটে বা বাহনে করে মসজিদ–এ–কুবায় আসতেন ২ রাকাত নামাজ পড়তেন।
মসজিদের গুরুত্বের দিক দিয়ে প্রথম মসজিদুল হারাম, অতঃপর মসজিদে নববী এরপর মসজিদে আকসা অতঃপর মসজিদ–এ–কুবা। অনেক ইমাম ধর্মীয় বিজ্ঞজন মসজিদ–এ–কুবার সাথে ফিলিস্তিনের হেবরনে মসজিদে ইব্রাহীমের কথাও উল্লেখ করেছেন।
নবী পাক (স.) নবুওয়াত জিন্দেগীর ১৩ সনে পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনার উদ্দেশ্যে হিযরত করেন। পবিত্র মদিনায় প্রবেশের আগে এই কুবা পল্লীতে মতান্তরে ১৪ দিন অবস্থান করেন। সাহাবাগণের সহযোগিতা নিয়ে এই কুবা পল্লীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কুবা একটি বিখ্যাত কূপ। তৎকালীন সময়ে এই কূপকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে ওঠে। সেই জনবসতি কুবা মহল্লা নামে পরিচিত হয়। কালের পরিক্রমায় এই সূত্রে আল্লাহর রাসূল (স.)’র নির্মিত মসজিদের নাম হয়ে যায় মসজিদ–এ–কুবা।
এখানে উল্লেখ্য পবিত্র কাবার দক্ষিণ পূর্ব দিকে জমজমের কূপ আবিষ্কার হওয়ার পর এই পানির কারণে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। যেমনটা পরবর্তীতে কুবার ক্ষেত্রেও হয়।
মাটি ও খেজুরের ডাল দিয়ে নির্মিত এই প্রথম মসজিদ বারে বারে সংস্কার পুনঃ নির্মিত হয়ে আসছে। ইতিহাসে জানা যায়, নবী পাক (স.) যখন এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন তখন কেবলার দিকে প্রথম পাথরটি নিজ হাতে স্থাপন করেন। মসজিদের জায়গাটি ছিল হযরত কুলসুম ইবনুল হিদম (র.)’র খেজুর শুকানোর জায়গা। তিনি ছিলেন আমর ইবনে আউফ এর গোত্রপতি।
৪ খলিফার আমলে পরবর্তীতে ওমাইয়া আব্বাসীয় আমলে এই মসজিদ সংস্কার পুনঃ নির্মাণ হয়ে আসছে। তুর্কি সুলতানী আমলে রওজা পাকসহ মসজিদে নববী পুনঃ নির্মাণের পাশাপাশি মসজিদ–এ–কুবাও পুনঃ নির্মাণ হওয়া স্বাভাবিক। যেহেতু তারা ৪ শত বছর বা কম বেশি সময় হেজাজ শাসন করে গেছেন। ১৯৮৬ সালের আগে মসজিদ–এ–কুবা ছোট কলেবরে সাদামাটা হিসেবে নির্মিত ছিল। বাদশাহ ফাহাদের আমলে ৪ মিনার বিশিষ্ট বর্তমান মসজিদটি নির্মিত হয়। এখানে প্রায় ২০ হাজার মুসল্লি এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারবে।
সাধারণত কাফেলা এজেন্সীরা একদিন সকালবেলা একটি বাস যোগে উপরোক্ত ৪ স্থানে যেয়ারত করিয়ে আনে। কাফেলা যদি অন্য ৩ স্থানে যেয়ারতের পর মসজিদ–এ–কুবায় আনা হয় তবে আপনি কাফেলার বাস থেকে পৃথক হয়ে এখানে সময় দিতে পারেন। যেহেতু এখানে দেখার জানবার অনেক কিছু রয়েছে। অতঃপর মসজিদে নববীর যোহরের জামাতের আগে আগে পায়ে হেঁটে অথবা ১০ রিয়াল দিয়ে ইলেকট্রনিক তথা বেটারীচালিত গাড়ি করে মসজিদে নববীতে চলে যেতে পারবেন। এই গাড়ি মসজিদে নববীর একদম নিকটে গিয়ে নামিয়ে দেয়।
এখানে উল্লেখ্য গত নভেম্বরের ১২ তারিখ বাংলাদেশ বিমানে জেদ্দা হয়ে পবিত্র মক্কা পৌঁছার সৌভাগ্য হয়। এখানে ১৪ দিন অবস্থানের পর সকালের ট্রেনে পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা যাওয়া হয়। পবিত্র মদিনায় ১৫ দিন অবস্থান করে বাংলাদেশ বিমানে পবিত্র মদিনা বিমান বন্দর হয়ে দেশে রওনা হই।
পবিত্র মদিনায় প্রথম শনিবার সকাল ১০ টার দিকে একটি টেক্সী নিয়ে যেয়ারতে বের হই। পরবর্তী তথা দ্বিতীয় শনিবার আবারও সকাল ১০ টার দিকে হোটেলের সম্মুখ থেকে টেক্সী নিয়ে প্রথমে উহুদে শহীদগণের যেয়ারতে যাই। এখান থেকে খন্দকের যুদ্ধের স্থান তথা সাত মসজিদ (সাবা মসজিদ) হয়ে মসজিদে কুবায় এসে টেক্সী ছেড়ে দিই। এখানে নামাজ পড়ার পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ সময় দেয়া হয়। অতঃপর ১০ রিয়াল দিয়ে বেটারী চালিত গাড়ি তথা ইলেকট্রনিক গাড়ি করে মসজিদে নববীতে চলে আসি যোহরের জামাতের আগে আগে।
উভয় পবিত্র নগরীতে আবহাওয়া ছিল মনোরম। পবিত্র মদিনায় ফজর নামাজ পড়তে যেতে হালকা শীত অনুভব হত। যা গরম কাপড় পরলে আরামদায়ক।
দেশ থেকে ব্যাপক হারে ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে দুই পবিত্র নগরীতে গমন করা হচ্ছে। হজ্ব নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু ওমরাহ বছরের যে কোনো সময়ে যাওয়া যায়। আবহাওয়ার দিকে খেয়াল করে গেলে এবাদত করতে আরাম পাওয়া যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।