নিজেকে যদি মুসলমান স্বীকার করি, স্বীকার করি মহান আল্লাহর বান্দা দু’জাহানের সরদার আল্লাহর রাসূল (স.)’র উম্মত, তবে আমাদেরকে অবশ্যই অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে থাকতে হবে। আল্লাহপাকের নির্দেশিত পবিত্র কুরআন মজীদে এবং আমাদের রাসূলের হাদীস শরীফ মতে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর সহ অবস্থানে সম অধিকার থাকতে হবে।
আমরা মুসলমান, মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করব। অপরদিকে সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থানে সকল ধর্মাবলম্বীর সম অধিকারে সম্মান দেখাতে হবে। নবী পাক (স.)’র পবিত্র মক্কায় ১৩ বছরের নবুওয়াত জিন্দেগীতে নবুওয়াত লাভ করে আল্লাহপাকের নির্দেশিত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আল্লাহপাকের একত্ববাদ প্রচার শুরু করেন। শান্তির ধর্ম ইসলাম। ইসলাম প্রচারও শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, তাঁরই বংশধর তথা কুরাইশবংশের নেতাগণের শুধু বিরোধিতায় নয় আল্লাহর রাসূল (স.)’র প্রতি জুলুম অত্যাচার শুরু করে। তারপরেও আমাদের রাসূল (স.) চরম ধৈর্যের সাথে সবর করে গেছেন। নবুওয়াত জিন্দেগীর পবিত্র মক্কায় ১৩ বছরের পর আল্লাহপাকের নির্দেশিত হয়ে পবিত্র মদিনায় হিজরত করেন। এখানে মুসলমানগণের পাশাপাশি ইহুদিগণের বসবাস ছিল। সম–অধিকার সহ–অবস্থানের নিমিত্তে আল্লাহর রাসূল (স.) তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। যা (পবিত্র) মদিনার সনদ নামে পরিচিত। ইহুদিরা বারে বারে এ চুক্তি লঙ্ঘন করছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (স.) ধৈর্যের পরিচয় দেন। আমরা মুসলমানগণ যদি মুক্ত ইসলাম তথা ইসলামের প্রথম চুক্তি অসাম্প্রদায়িক সহ অবস্থানের চুক্তি তথা (পবিত্র) মদিনার সনদকে বিশ্বাস করি সম্মান করি তবে আমরা সাম্প্রদায়িক হতে পারি না।
সাম্প্রদায়িকতা ইসলাম ধর্ম মতে খুবই ঘৃণ্য বিষয়। শুধুমাত্র ধর্ম পালনে আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্ম আমরা পালন করব; এতে কোন আপস হবে না। বাকী সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থানে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক সকল ধর্মাবলম্বী সহ অবস্থানের অধিকারকে স্বীকার করে নিতে হবে। অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি উদাহরণ আল্লাহর রাসূল (স.) প্রতিবেশীর অধিকারকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। প্রতিবেশীর মধ্যে মুসলিম অমুসলিম ভাগ করা হয়নি। তেমনিভাবে ব্যবসা–বাণিজ্যে কাজে–কর্মে অসাম্প্রদায়িক সম অধিকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের দেশে মাঝে মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য হয়নি তা নয়। যাকে খুব ঘৃণ্য চোখে দেখতে হবে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করে যা কাম্য ছিল না। আমাদের এই নব প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিনষ্ট হয় নাই তা নয়। মুসলমান নামধারী দুষ্ট লোকেরাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। তেমনিভাবে অনেক বাঘা বাঘা মুসলমান নেতা ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যাতে কলুষিত না হয় সে জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তৎমধ্যে আমার পিতা আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তথা সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে বাঁশখালীতে।
১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়। যা কাম্য ছিল না। অতঃপর ১৯৯২ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা হলে আমাদের দেশে কোন এলাকায় সংখ্যালঘুদের মন্দির আক্রান্ত হয়। যা মুসলমানের জন্য শুভনীয় নয় ঘৃণ্য কাজ। তেমনিভাবে গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে কোন কোন স্থানে সংখ্যালঘুদের ঘর–বাড়ি সম্পদ আক্রান্ত হয় বলে শুনা যায়। বাস্তবতার চেয়ে অপপ্রচার বেশি হয়েছে বলে শুনা যায়। মুসলমানগণের যারা করেছে তা তাদের জন্য জঘন্য কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অপরদিকে এও সত্য যে, মাদ্রাসার ছাত্রসহ অসংখ্য ন্যায়পরায়ণ বিবেকবান ব্যক্তি সংখ্যালঘুদের মন্দিরসহ অনেক স্থাপনা রাত দিন শ্রম দিয়ে পাহারা দিয়েছিল। যা শুধু আমাদের দেশ নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমও স্বীকার করেছে। ইহাও আমাদের মুসলমানদের ধর্মের অঙ্গ বলা যায়। যেহেতু মানবের জানমাল, সম্পদ রক্ষা করতে পারা পূণ্যের কাজ। আমাদের রাসূল (স.) বলে গেছেন, ঐ মানুষ শ্রেষ্ঠ যে মানুষের উপকার করে। যারা সংখ্যালঘুদের মন্দিরে সম্পদে আঘাত করেছে তারা ঘৃণ্য কাজ করেছে। অপরদিকে যারা এসব রক্ষায় তৎপর হয়েছে, সময় দিয়েছে তারা মানবতার পক্ষেই কাজ করেছে; করেছে পূণ্যের কাজ। মানবতাও ধর্ম। মুসলমান হিসেবে স্বীকার অপরদিকে মানবতা ভূলুণ্ঠিত করব তা হতে পারে না।
সব চাইতে অবাগ করা ব্যাপার ৫ আগস্ট সরকার পতনের সাথে সাথে গণভবনসহ সারা দেশে কম বেশি লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান বিশ্ব তথ্য প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যুগ। প্রচার মাধ্যম বিশ্বব্যাপী মানুষের ঘরে ঘরে। আমাদের বাংলাদেশী কিছু মানুষের এই রকম ঘৃণ্য নিকৃষ্ট চরিত্র তা বিশ্ব দেখেছে। বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ এই বাস্তব চিত্র দেখেছে। বিশ্বের বুকে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি যে কিভাবে ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে ভাবি। সুযোগ পেলেই যে আমরা চরিত্র ঠিক রাখতে পারি না।
১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর মনে হয় এই প্রথম কিছুটা হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় যা কাম্য ছিল না। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সহ অবস্থানে সুনামের অধিকারী। দেশে রাজনৈতিক হানাহানি, দলাদলি থাকলেও, রাজনৈতিকভাবে বাদে সাধারণের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুক ছিল। আশা করব, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করেছে তারা অনুতপ্ত হবে। ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি অটুক থাকবে এই আশা ব্যক্ত করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।