গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা তথা কুত্বুল আলম সুলতানুল আউলিয়া আলহাজ্ব হযরত শাহ মাওলানা আবদুল মজিদ (রহ.)। যিনি মোহসেনিয়া মাদ্রাসা (বর্তমানে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ) থেকে কৃতিত্বের সাথে ফাজিল পাস করেন। মোহসেনিয়া মাদ্রাসার খ্যাতিমান কৃতি ছাত্র বিধায় কয়েক শ মিটার দূরত্বে দারুল উলুম মাদ্রাসায় খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন সেই মাদ্রাসার শিক্ষকগণের অনুরোধে।
পিতা ইন্তেকাল করে গেছেন, ৩ ভ্রাতা ৫ বোনের মধ্যে বড় ভ্রাতা হিসেবে তিনি অভিভাবক। ১৯২০ সালে বাড়ির নিকটে প্রতিষ্ঠা করেন গারাংগিয়া মাদ্রাসা। ১৯২১ সালে বিশ্বখ্যাত সুফি দরবেশ হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) উত্তরপ্রদেশ ভারত প্রকাশ আজমগড়ী হযরতের নিকট তরিকতে দাখিল হন। মাদ্রাসা পরিচালনার পাশাপাশি তরিকতের কাজ রিয়াজত চালিয়ে যেতে থাকেন।
নিজের পীর আজমগড়ী হযরত প্রতি বছর ন্যূনতম একবার হলেও চট্টগ্রাম সফর করতেন। ফলে হযরত বড় হুজুর কেবলা আজমগড়ী হযরতের চট্টগ্রাম সফরকালে তার সান্নিধ্যে সময় দিতেন। সাথে সাথে আজমগড় গমন করতেন নিজের পীরের তথা শেখের সোহবত লাভ করতে। এভাবে নিজের পীরের সান্নিধ্যের মাধ্যমে মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি তরিকতের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৪৪ সালে হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সালাম আরাকানী (রহ.) (আরাকানী হযরত) সহ নিজেদের পীরের সান্নিধ্য লাভ করতে উত্তর প্রদেশের আজমগড় গমন করেন। তথায় হযরত বড় হুজুর কেবলাকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। হযরত বড় হুজুর কেবলাকে খেলাফত প্রদানকালে নিজের শেখ তথা আজমগড়ী হযরত বড় হুজুর কেবলার প্রতি আস্থা বিশ্বাস রেখে বলেন, তিনি যাতে তরিকতের খেদমতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।
ফলে ১৯৪৪ সাল থেকে দীর্ঘ প্রায় ৩২/৩৩ বছর গারাংগিয়া মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি তরিকতের খেদমতে চট্টগ্রামে ব্যাপক সফর করেন। তথা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলা। ঢাকাসহ দেশের অন্যত্রও মাঝে মধ্যে সফর করতেন। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক চালু হয় ১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে। তার আগে সুন্দর মসৃণ যাতায়াত ছিল না। নৌপথে ইঞ্জিনবিহীন নৌকা সাম্পান অথবা পায়ে হেঁটে গমনাগমন ছিল অন্যতম মাধ্যম।
১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত মুষ্টিমেয় জমিদার বাড়ী বাদে শতকরা ৮০/৯০ জনের বাড়ী ঘর ছিল হয়ত মাটির দেয়াল অথবা বাঁশের বেড়া, টিন বা ছনের ছাউনী। টয়লেট থাকত বাড়ী থেকে কিছুটা দূরত্বে। শতে ২/৪ জনের কাছারী ঘর ছিল বলে মনে হয় না। এমনি প্রতিকূলতায় হযরত বড় হুজুর কেবলা নিজের আরাম আয়েশকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিকূল যোগাযোগেও তরিকতের খেদমত আনজাম দিতে কুন্ঠিত হননি। তিনি কঙবাজার সফর করতেন বাড়ী থেকে পায়ে হেঁটে আমিরাবাদ, তথা হতে চাঁন্দের গাড়ী তথা ভাঙ্গাচূড়া গাড়ি করে যেতেন চিরিঙ্গা। সেখান হতে ভাটাখালী নদী ঘাট হয়ে সাম্পান যোগে যেতেন কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে প্রতিকূল যোগাযোগেও উখিয়া, হ্নীলা, টেকনাফ সফর করতেন। সফর করতেন চ্যানেল পার হয়ে কুতুবদিয়া, মহেশখালী। গারাংগিয়া থেকে বাঁশখালী যেতে হত পাহাড় অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে। গারাংগিয়া থেকে ৪/৫ কি.মি দূরত্বে ঘাটিয়াডাঙ্গা। তথা হতে গদু নৌকা তথা বৃহৎ আকৃতির ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় রাত্রিযাপন করে ভোরে পৌঁছতেন চাক্তাই ঘাটে। এই রকম প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়াতে ব্যাপক সফর করেন। নদী পথে পায়ে হেঁটে আরও সফর করেন রামগড়, খাগড়াছড়ি, চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এসব অঞ্চলে। তিনি তরিকতের সফরে যেখানেই যান না কেন তথায় মসজিদ, খানকাহ, মক্তব প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকতেন।
হযরত বড় হুজুর কেবলার মতাদর্শ তথা আজমগড়ী হযরতের মতাদর্শ হল কঠোর শরীয়তে থেকে তরিকতের খেদমত করা। মিলাদ কিয়ামসহ সুন্নি মতাদর্শে অটল থাকা। অপরাপর মতাদর্শকে মন্দ বা খারাপ না বলা।
১৯৪৪ সাল থেকে খেদমতের ফসল হিসেবে মাত্র ৫/৭ বছরের ব্যবধানে ১৯৫০/১৯৬০ এর দশকে হযরত বড় হুজুর কেবলার প্রতি সব মহলে অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। ধর্মীয় জগতে প্রিন্সিপাল, মুহতামিম, মুহাদ্দিস, ইমাম, খতিব, মাস্টার, প্রফেসর, অধ্যক্ষ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি তথা প্রত্যেক স্তরের জনগণের মাঝে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুরের প্রতি অন্তরের গভীর থেকে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত গারাংগিয়া মাদ্রাসার প্রধান হিসেবে তাঁকে হযরত সুপারিনটেনডেন্ট হুজুর হিসেবে সম্বোধন করা হত। তেমনিভাবে তাঁর অনুজ তথা সহোদর ছোট ভ্রাতা হযরত ছোট হুজুর কেবলাকে গারাংগিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক তথা আউয়াল ছাহেব হুজুর হিসেবে সম্বোধন করা হত। হযরত বড় হুজুর কেবলা চট্টগ্রামে যে বাড়ীতে অবস্থান নেন না কেন দোয়া প্রার্থী অসংখ্য মানুষের ঢল নামত। হযরত বড় হুজুর কেবলার জীবনে রয়েছে অসংখ্য কারামাত। তৎমধ্যে অন্যতম একটি হল তাঁর ইন্তেকালে জানাযা।
হযরত বড় হুজুর কেবলা ১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর শুক্রবার সকালে গারাংগিয়া নিজ বাড়ীতে ৮৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ঐ সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছিল না। ল্যান্ডফোনের ব্যবহার ছিল শহরের ভিতর সীমিত পরিসরে। মাইকের তেমন প্রচলন ছিল না। মাইক ব্যবহার করতে প্রস্তুতির জন্য আগে থেকে অর্ডার দিতে হত। যেহেতু ব্যাটারীর চার্জ দেয়া, মাইক ব্যবহারের লোককে আগে থেকে ঠিক করে রাখা এসব কারণে। অবাক করা ব্যাপার বেলা ১০/১১ টা হতে না হতেই বৃহত্তর চট্টগ্রামে হযরত বড় হুজুর কেবলা ইন্তেকালে খবর অলৌকিকভাবে ব্যাপক প্রচার হয়ে যায়। এ সংবাদ ঢাকাসহ অন্যত্রও পৌঁছে যায়। ঢাকা–কক্সবাজার কথা বলতে হত টিএন্ডটির মাধ্যমে কল বুক করে। তা ছিল সময় সাপেক্ষ। অনেক সময় লাইন প্রতিকূলতায় কথা বলা যেত না।
এমনি পরিবেশে গারাংগিয়া অভিমুখী মানবের ঢল নামে। আমি নিজেও বেলা ১১ টার দিকে সংবাদ পেয়ে যাই। ঐ সময় চট্টগ্রামে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক ছিল হাতেগোনা। ভগ্নিপতি এডভোকেট ফরিদ আহমদ চৌধুরীর নিজস্ব গাড়ি ছিল। তিনিও পীর ভাই তথা হযরত বড় হুজুর কেবলার সরাসরি মুরিদ। সময় বাঁচানোর জন্য আমরা উভয়ে তার জীপ নিয়ে আন্দরকিল্লা চলে আসি শাহী জামে মসজিদে জুমা পড়তে। জুমার নামাজ পড়ার সাথে সাথে আমরা গারাংগিয়া অভিমুখে রওনা হয়ে যাই। আরাকান মহাসড়ক ছিল সরু। আরাকান মহাসড়কে দু’টি গাড়ি অতিক্রম করতে গতি কমিয়ে দিতে হত। কালুরঘাট সেতু পার হয়ে কিছুদূর যেতে না যেতে বায়তুশ শরফের পীর ছাহেব হযরত শাহ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.)’র টুয়েটা কার গারাংগিয়া অভিমুখে আমাদের জীপের আগে পরে চলতে ছিল। এক গাড়ি আরেক গাড়ি অতিক্রমের সময় হযরত আবদুল জব্বার (রহ.)’র সাথে আমার মুচকি হাসি হত। সাতকানিয়া উপজেলার সদর পৌঁছে ডলুখালের পূর্বদিক দিয়ে গারাংগিয়ামুখী যেতে মানব স্রোত দেখে হতবাক হচ্ছিলাম। ডলুখালের চরে (নদীর) পূর্বপাড়ে, পশ্চিমপাড়ে জানাযার কাতার। জানতে পারি জানাযায় কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত তথা ৭/৮ কোটি লোকের মধ্যে প্রতিকূল যোগাযোগেও কয়েক লাখ লোকের সমাগম হয়। এই থেকে রাত দিন হাজার মানুষের সমাগম ঘটে গারাংগিয়া অভিমুখে পরে সংবাদ পেয়ে কবর যেয়ারত করে ধন্য হতে।
গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলা ইন্তেকাল করে গেছেন ৪৭ বছর। আজ দেশে তাঁর উছিলায় শতের কম–বেশি দাখিল থেকে কামিল মাদ্রাসা রয়েছে। মসজিদ, খানকাহ, মক্তব, এবতেদায়ী মাদ্রাসার সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন হবে। ১৯৯০ এর দশকের পর থেকে দেশে মোবাইলসহ নানান আবিষ্কার, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে ধর্মীয় জগতে বিরূপ পড়াব পড়ে। তেমনিভাবে বিরূপ প্রভাব পড়ে তরিকত জগতেও। তাই বলে আগেকার সুন্দর পরিচ্ছন্ন তরিকতকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখলে ভুল হবে। তকদিরে পোকা লাগতে পারে। হযরত বড় হুজুর কেবলা ছিলেন দেশের সকল মতাদর্শের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজিজুল হক (রহ.), চকরিয়া খতিবে আজম হযরত মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)সহ দেওবন্দ মতাদর্শ হযরত বড় হুজুর কেবলাকে সম্মান করতেন। হাটহাজারী হযরত শেরে বাংলা আজিজুল হক (রহ.), জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিব অধ্যক্ষ হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন আল–কাদেরী (রহ.), শত বছর হায়াত প্রাপ্ত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) সহ সুন্নি জগত হযরত বড় হুজুরকে সম্মানের চোখে মূল্যায়ন করে গেছেন। হযরত বড় হুজুর কেবলার ইন্তেকালের ২৩ বছর পর ২০০৩ সালে ৪৩২ পৃষ্ঠাব্যাপী তাঁর মোবারকগ্রন্থ লেখার সৌভাগ্য হয় আমার। এতে তাঁর জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে বড় হুজুর কেবলা যে সকল মতাদর্শের শ্রদ্ধাভাজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব তা জানা যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক