প্রবাহ

হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৪ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

২৮ সফর ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানী হযরত শেখ আহমদ ফারুকী (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। বিশ্বের বুকে তিনি হাজার বছরের মুজাদ্দেদ হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর মহান পিতা শেখ আবদুল আহাদ তৎকালে শ্রেষ্ঠ বুর্জুগানের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সেরহিন্দে/শেরহিন্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত শেখ আবদুল আহাদ (রহ.) হিজরি ১০০৭ সালের ১৭ রজব ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। সেরহিন্দেরই ইমামে রব্বানীর মাজার কমপ্লেক্সের মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যে তিনি শায়িত আছেন। হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানীর উর্ধ্বতন পূর্ব পুরুষ ছিলেন আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রহ.)

নবী রাসূলগণের অনুকরণে বিশ্বখ্যাত মহান অলিগণের জীবনী তালাশ করলে জানা যাবে জন্মের পর থেকেই সাধারণের চেয়ে ব্যতিক্রম। উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়ে বয়স বাড়তে থাকে। হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানীর ক্ষেত্রেও ভিন্নতা ছিল না। তিনি শৈশবে পিতা মাতার নিকট শিক্ষা জীবন শুরু করেন, কুরআন হেফজ করেন। অতঃপর ঐ অঞ্চলে বড় বড় আলেমগণ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। ঐ সময় তিনি তাসাওউফ বা মারফত সম্মন্ধীয় একাধিক কিতাব অধ্যয়ন করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জাহেরী বাতিনী এলমের এক বিরাট ভান্ডারে পরিণত হন। তাঁর পূর্ব পুরুষ সকলেই তাসাওউফ পন্থী। কাজেই মারফত অর্জন ওয়ারিশসূত্রে লাভ করেছিলেন। প্রথমে তিনি তাঁর পিতার নিকট মারফত বিদ্যা অর্জন করেন। তাঁরই নিকট থেকে চিশতিয়া তরিক্বার খেলাফত প্রাপ্ত হন। অতঃপর পিতার নিকট থেকে কাদেরিয়া তরিক্বার ছবকও গ্রহণ করতে থাকেন। পরে তৎকালের কাদেরিয়া সিলসিলার শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ হযরত শাহ সেকান্দর (রহ.)’র নিকট থেকে এ তরিক্বায় খেলাফত লাভ করেন।

হিজরি ১০ম শতাব্দীর শেষ ভাগে বাদশাহ আকবর প্রকাশ্যভাবে সুন্নতে নববীর বিরোধিতা করতে তাকে। কতিপয় দুনিয়াদার আলেম বাদশাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার উদ্দেশ্য ধর্ম সম্পর্কে বাদশাহের ধর্ম বিরোধী মতবাদ সমর্থন করেন।

হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী এলম হাসিল করার পর যৌবনের প্রারম্ভে বাদশাহ আকবর এর রাজধানী আগ্রায় গমন করেন। বাদশাহের সেনাবাহিনীর অনেকেই তার জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হন। এমনকি তৎকালীন আলেমগণ তাঁর নিকট থেকে হাদীস ও তাফসীরের উপর সনদ গ্রহণ করতে চান। এতে তাঁর ইলম ও ইজতিহাদের খ্যাতি চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

আগ্রায় অবস্থানকালে হযরতের খ্যাতি চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শাহী দরবারের দর্শন ও তর্ক শাস্ত্রের বিখ্যাত ও বিচক্ষণ আলেম বাদশাহ আকবরের অতি প্রিয় পাত্র আবুল ফজল ও ফয়জী হযরতের মজলিশে আগমন করতেন।

হযরত দীর্ঘদিন আগ্রা তথা আকবরাবাদে অবস্থানের পর তাঁর পিতা তাঁেক সেরহিন্দ নিয়ে যান। পথিমধ্যে বাদশাহ আকবরের এক বিশেষ আমত্য শেখ সুলতানের কন্যার সাথে হযরত মুজাদ্দেদীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ বিবাহ সম্পর্কে নবী পাক (.) শেখ সুলতানকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। শেখ সুলতান ছিলেন বাদশাহ আকবরের পক্ষে তানশস্বরের শাসনকর্তা। এ বিবাহের অলৌকিকত্ব নিয়ে দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে।

হিজরি ১০০৭ সনে তাঁর বুজুর্গ পিতার ইন্তেকালের পর ঐ বছরই তিনি হজ্বের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে পৌঁছেন। এখানে হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ.)’র সাথে মোলাকাত হয়। এতে অল্প দিনের মধ্যে নকশবন্দিয়া সিলসিলার উচ্চস্তরে পৌঁছে যান। হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ.) হতে এ তরিক্বার খেলাফত লাভ করেন।

বাদশাহ আকবর ১৩ বছর ৪ মাস বয়সে তাঁর পিতা বাদশাহ হুমায়ুন ইন্তেকাল করেন। এতে বাদশাহ আকবর সিংহাসনের অধিকারী হলেও অভিভাবক বৈরামখান রাজ্য শাসন করতে থাকেন। অল্প দিনের মধ্যে বাদশাহ আকবর বৈরামখান থেকে সমস্ত শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ৫০ বছরের অধিককাল বাদশাহী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার ব্যাপক ক্ষমতায় তিনি আত্নগর্বে বলীয়ান হয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি ইসলাম ধর্মকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হন। ফলে সকল ধর্মকে একত্রিত করে নতুন ধর্মের সিদ্ধান্ত নিতে তার মনে আগ্রহ জাগে। তিনি দ্বীনি ইলাহি নতুন ধর্মের আবির্ভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। বাদশাহর প্রিয় পাত্র হতে কিছু কিছু আলেমও এতে সমর্থন করে বসে। ঐ সময়কার মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হযরত মোল্লা আবদুল কাদের বাদাউনী অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেন,মাত্র ৫/৬ বছরের ব্যবধানে ভারতে ইসলামের নাম নিশানাও বাকি রইল না। আকবর তার খুশি মত নতুন ধর্মের নামে যা যা করা দরকার তা তা করে যেতে লাগল।

এমনি পরিস্থিতিতে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবর মৃত্যুর মুখে পতিত হন। এতে তার পুত্র জাহাঙ্গীর ৩৬ মতান্তরে ৩৮ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর বাদশাহী পদে বসে পিতার অনুকরণ অনুসরণে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন। জাহাঙ্গীর পিতার সম্মতি না পাওয়ায় নূর জাহানকে বিয়ে করতে পারেননি। পিতার মৃত্যুর পর নিজের ক্ষমতাবলে ১০ বছরের এক কন্যা সন্তানের মা নূর জাহানকে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে বিবাহ করে নেন। এতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে নূর জাহান রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালী বেগম। এদিকে হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী ব্যাপক সমালোচনার প্রতিবাদের মুখে বাদশাহ জাহাঙ্গীর ও তার বেগম নূর জাহান সিংহাসনের জন্য হুমকি মনে করে তাকে নজরবন্দী করেন। অতঃপর তাঁকে গোয়ালিয়রের দুর্গে প্রেরণ করেন। যা জাহাঙ্গীরের সিংহাসনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মহান মুজাদ্দেদ সম্পূর্ণ ছবর ধৈর্যের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। ভারতবর্ষের বিখ্যাত এ দুর্গে শত শত বন্দী হযরত মুজাদ্দেদ এর সংস্পর্শ পেয়ে আল্লাহপাকের মকবুল বান্দায় পরিণত হয়ে যায়। অপরদিকে, জাহাঙ্গীরের প্রভাবশালী আমাত্যবর্গ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এদিকে জাহাঙ্গীরের পুত্র খুররম তথা পরবর্তীতে প্রকাশ বাদশাহ শাহ জাহান হযরত মুজাদ্দেদ এর ভক্ত ছিলেন, শ্রদ্ধা রাখতেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর ও বেগম নুর জাহান বুঝতে পারলেন যে, মুজাদ্দেদকে গ্রেফতার করা চরম ভুল হয়েছে। তাদের সিংহাসন ঢলমল। হযরত মুজাদ্দেদের সাথে এ বিদ্রোহের পর্যায়ে। এ রকম প্রতিকূল অবস্থায় হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী গোয়ালিয়র দুর্গ থেকে নির্দেশ পাঠান, সকলে যাতে শান্ত থাকেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের যাতে ক্ষতি না হয়। শুধু তাই নয় পুত্র খুররমও পিতার নিকট দাবী জানান এ অন্যায় কাজ থেকে সরে আসতে।

ফলে বাদশাহ জাহাঙ্গীর অনুতপ্ত হন হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানীকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে তাঁর মতাদর্শে তথা ইসলামের মূল নীতি মতে ভারতবর্ষ পরিচালিত হবে বলে প্রতিঙ্গাবদ্ধ হন। এতে তাঁর পিতা প্রবর্তিত দ্বীনে ইলাহি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতবর্ষের মানুষ যার যার ধর্মে মূল নীতিতে ফিরে যান।

এ মহান মুজাদ্দেদে আলফেসানী তথা হাজার বছরের মুজাদ্দেদ পাঞ্জাবের সেরহিন্দে নিজ জন্মস্থানে ফিরে গেলে সেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন। তথায় প্রায় ২০/৩০ একর এরিয়া নিয়ে তাঁর মাজার কমপ্লেক্স।

বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ পেরিয়ে তাঁর প্রবর্তিত মুজাদ্দেদীয়া তরিক্বার কোটি কোটি মুরিদ। বর্তমানকালে আমাদের বাংলাদেশেও কোটির অধিক মুরিদ হতে পারে।

দিল্লি থেকে উত্তরপশ্চিম দিকে ২৫০ কি.মি দূরত্বে সেরহিন্দের অবস্থান। যা দিল্লিপাঞ্জাব মহাসড়ক ও ট্রেন লাইন থেকে মাত্র ৩/৪ কি.মি দূরত্বে।

রাজধানী দিল্লি থেকে ট্রেনে ও সড়কপথে আরামদায়ক যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে সেরহিন্দে। দিল্লি থেকে বিলাসবহুল বন্দে ভারত শতাব্দী এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন মানের ট্রেনে সেরহিন্দ যাওয়া হয়। অপরদিকে চট্টগ্রামঢাকার মত ডিভাইটেড দিল্লিপাঞ্জাব হাইওয়ে রয়েছে। দিল্লি থেকে সেরহিন্দের দূরত্ব ২৫০ কি.মি। যা সড়কপথে চট্টগ্রামঢাকার দূরত্বের মত। মহাসড়ক থেকে ৩/৪ কি.মি এর মধ্যে মাজার কমপ্লেক্স।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুর ডায়রিয়া রোগ
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাহী আদেশে নয়, গণশুনানিতেই নির্ধারণ গ্যাস-বিদ্যুতের দাম