প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৪ আগস্ট, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

হারামাইন তথা মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীতে তীব্র তাপমাত্রা থেকে সুরক্ষার জন্য জুমার খোতবা ও নামাজের সময় সংক্ষিপ্তকরণে নির্দেশ দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। সেই মতে হজ্বের পর জুমা হতে কার্যকর হয়। গত হজ্বে অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটেনি। তারপরও এত বেশি হজ্বযাত্রীর মৃত্যু হয় যা অস্বাভাবিক। এতে বাংলাদেশের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে হজ্বের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়। আমার নিজেরও বৃদ্ধ বয়সে হজ্ব করার জন্য তথায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হওয়ায়, নিজেও অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারি।

মসজিদুল হারম, মসজিদে নববীতে জুমায় ব্যাপক সমাগম হয়। তার মূলে শুক্রবারে সৌদি আরবে সরকারী বন্ধ। হজ্ব ওমরাহকারীর পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে পবিত্র কাবা কেন্দ্রিক ওমরাহ করবে অথবা পবিত্র মদিনায় রওজাপাকে সালাম পেশ করতে লাখ লাখ নরনারীর ঢল নামে।

হজ্বের পর কাবা শরীফ কেন্দ্রিক মসজিদুল হারমের জুমায় অনুভব করতে পারি তীব্র তাপমাত্রা তথা ৪৫/৫০ ডিগ্রী তাপদাহের মধ্যে জুমার খোতবা ও জামাত সংক্ষিপ্তকরণ হল। এতে আমার কানে শব্দ আসে সৌদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছেন তীব্র তাপদাহের কারণে লাখ লাখ নামাজীর কল্যাণে জুমা যাতে সংক্ষিপ্তকরণ করা হয়।

যোহরের ৪ রাকাত ফরজ নামাজের স্থলে শুক্রবার জুমাকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ খোতবা আরেক ভাগ ২ রাকাত ফরজ নামাজ। আমাদের দেশের মত দুই হারমে জামাতে দুই রাকাত নামাজে সূরার চেয়ে খোতবা অনেক দীর্ঘায়িত হয়। হয়ত ২০/২৫ মিনিট। জুমায় মসজিদুল হারম পরিপূর্ণ হয়ে চর্তুদিকে খোলা চত্বর পূর্ণ হয়ে রাস্তায় লাখ লাখ নামাজী অবস্থান নেয়।

আগেই অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, হেজাজ ভিত্তিক জজিরাতুল আরব মরুভূমি প্রবণ, অত্যধিক গরম অঞ্চল; ব্যতিক্রম কিছু এরিয়া বাদে। কিন্তু ওখানকার অধিবাসীরা এ পরিবেশে অভ্যস্ত জীবনযাপনকারী। তাদের শরীরের গঠন বড় ও শক্তিশালী, অপরদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হজ্বযাত্রী, ওমরাহকারী এবং বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের মধ্যে এ দু’টির একটিও নেই। অর্থাৎ শারীরিক সক্ষমতা সৌদিদের মত নেই বলা যাবে।

জুমা পড়তে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা বা তারও অধিক সময় খোলা আকাশের নিচে ৪৫/৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় মসজিদুল হারমের চত্বরে অথবা রাস্তায় যেনতেন স্থানে অবস্থান নিতে হয়।

জুনের মাঝামাঝি তথা প্রচন্ড গরমের মধ্যে হজ্ব হচ্ছে। তা আগামী ১৫/২০ বছর গরম কালেই হজ্ব হবে। এমনিতেই ৪২৫ কি.মি উত্তরে পবিত্র মদিনায় শীতকালে প্রচন্ড শীত পড়ে, কিন্তু মক্কার আবহাওয়া ব্যতিক্রম। শীতকালেও তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও শীত অনুভূত হয় না। পুরো শীতকালে মাঝে মধ্যে ২/১ দিন তাপমাত্রা কমে যায় মাত্র।

গত হজ্বে কোন অঘটন না ঘটার পরেও ১৩ শতের অধিক হজ্বযাত্রী মারা যায়। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে হজ্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে সৌদি সরকারের আলোচনা সমালোচনা হয়। এতে হয়ত সৌদি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে টনক নড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় দুই হারমে জুমার নামাজ সংক্ষিপ্ত করতে।

হজ্ব, রমজান মাসের পরেও সাপ্তাহিক মসজিদুল হারম কেন্দ্রীক রাস্তায় লক্ষাধিক মানুষের প্রতি জুমায় অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। তাও জুমার আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা বা তারও আগে থেকে।

হজ্ব উপলক্ষে মাসের কম বেশি সময় মসজিদুল হারমের নিকটে অবস্থান নেন লাখ লাখ হজ্বযাত্রী। উদ্দেশ্য হজ্ব উপলক্ষে পবিত্র মক্কায় এসে ৫ ওয়াক্ত নামাজ যাতে মসজিদুল হারমে পড়তে পারেন। সাথে সাপ্তাহিক জুমা ত আছেই।

আফসোসের বিষয় ৫ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে মসজিদুল হারমের চত্বরে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তায় নামাজ পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। জুমায় এ ব্যারিকেড ২ ঘণ্টা বা তারও আগে থেকে।

শতভাগ সক্ষম মানুষ বাদে ২ ঘণ্টারও অধিক সময় টয়লেটে না যাওয়া, অজু রাখা সহজ নয়। টয়লেট ত নয়ই অজু ভেঙ্গে গেলে মসজিদুল হারম থেকে চলে আসা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

মসজিদুল হারম কেন্দ্রীক প্রায় প্রতি ওয়াক্তে রাস্তায় নামাজ পড়তে হবে। জুমায় মসজিদুল হারমের চর্তুদিকে রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ অবস্থান করতেছে।

বারে বারে বিভিন্ন প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, বিশ্বে ২ শত কোটি মুসলমানের বাস। আকাশপথ দ্রুততার সাথে উন্নতি লাভ করে। প্রতিনিয়ত ওমরাহ এর জন্য মুসলিম নরনারী পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনা গমন করতেছে। এতে হজ্ব ওমরাহকারীগণ সাথে সাথে প্রবাসীরা মসজিদুল হারমে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে ও তাওয়াফ করতে যাতে প্রতিকূলতার সম্মুখীন না হয় সেই লক্ষে মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ করা হোক। যা সময়ের দাবী।

হজ্বের পরের জুমায় খোতবা ও নামাজ সংক্ষিপ্ত হওয়ায় হজ্বযাত্রীগণের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় সৌদি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা করা হয়েছে। মসজিদুল হারমে হজ্বের পরের জুমা এবং মসজিদে নববীতে তার পরের জুমায় সংক্ষিপ্ত সময়ে খোতবা ও নামাজ পড়া অনুভব করি।

মসজিদে নববীও সম্প্রসারণ আবশ্যক হয়ে গেছে। তবে এখনও পবিত্র মক্কার মসজিদুল হারমের মত নয়। মসজিদুল হারমে ১০/১২ লাখ কম বেশি ধারণ ক্ষমতা বলে জানা যায়। ২/৩ লাখ নরনারী এক সাথে তাওয়াফ এবং ৫০ লাখ থেকে এক কোটি নামাজীর ধারণ ক্ষমতার পরিকল্পনা নিয়ে সৌদি সরকারকে মসজিদুল হারমের সম্প্রসারণ কাজ শুরু করে দিতে হবে। যাতে নামাজ পড়তে গিয়ে ব্যারিকেডের সম্মুখীন হতে না হয়। আগেও উল্লেখ করেছি, হজ্ব ওমরাহকারীর কল্যাণে সৌদি সরকারের তিনটি অবদান স্মরণযোগ্য।

. নিরাপত্তা:-হজ্ব ওমরাহকারী মানে বিদেশ থেকে আগত। তাদের কঠোর আইনে হজ্ব ও ওমরাহকারীগণ যে হারে নিরাপত্তা পাচ্ছে তা বিশ্বের বুকে আর ২/১ টি দেশ আছে কিনা বলা মুশকিল।

. পবিত্র নগরীতে সারা বছর লাখ লাখ হজ্ব, ওমরাহ, যেয়ারতকারী অবস্থান করতেছে। কিন্তু কোথাও অপরিষ্কার ত নয়, কোন দুর্গন্ধ অনুভব হবে না।

. দুই হারমে লাখ লাখ হজ্ব,ওমরাহ, যেয়ারতকারী হাত বাড়ালেই জমজমের পানি খেতে পারা যায়।

১৯৮০/৯০ এর দশক থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধারণাতীত উন্নতি লাভ করতে থাকায় পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনা দুই হারমে হজ্ব, ওমরাহ যেয়ারতের লক্ষে সমাগম দ্রুততার সাথে বেড়ে যাচ্ছে।

১৯৮৫ সালে বাদশাহ ফাহাদ মসজিদে নববী দৃষ্টিনন্দন বিশালভাবে সম্প্রসারণ এবং পবিত্র নগরী মদিনাকে সাজিয়ে দিয়ে গেলেও পবিত্র কাবা কেন্দ্রীক মসজিদুল হারমের তা হয়নি। যা হচ্ছে তা যথাযথ নয়, নয় পরিকল্পিতভাবে। ফলে দীর্ঘ ২০/৩০ বছর যাবৎ মসজিদুল হারমের চর্তুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে নামাজীকে আটকানো অনেকটা স্বাভাবিকে পরিণত। হজ্ব ও রমজানে এই ব্যারিকেড আরও কঠোর হয়।

গত স্বাভাবিক হজ্বে ১৩ শতের অধিক হাজী মারা যাওয়ায় সৌদি সরকার এ নির্দেশে হজ্বের পর দুই হারমে জুমা সংক্ষিপ্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয় তা সমাধান নয়।

মসজিদুল হারম বিশালভাবে সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। নিকটস্থ অন্যান্য বিশাল বিশাল হোটেল প্যালেস ভেঙ্গে মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ করতেই হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কষ্ট স্বীকার করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পবিত্র মক্কায় ও পবিত্র মদিনায় যাচ্ছেন হজ্ব ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। তারা যাতে শান্তিতে নামাজ পড়তে পারে পবিত্র কাবার মাতাফে তাওয়াফ করতে পারে তার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।

বর্তমানে লাখ লাখ নামাজী মসজিদুল হারমে প্রবেশ করতে না পেরে বাহিরে নামাজ পড়তে হচ্ছে। হজ্বের সময় ৪৫ ডিগ্রী কম বেশি তাপমাত্রায় বাহিরে রাস্তায় যোহর আছর নামাজ পড়তে হচ্ছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।

অতএব জুমার সংক্ষিপ্তকরণ কোন সমাধান নয়। সমাধান হল মসজিদুল হারম বিশালভাবে সম্প্রসারণ করা। যাতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি নামাজীর ব্যবস্থা হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধরেমিট্যান্স যোদ্ধা ও জাতির দায়বদ্ধতা
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় গ্যাসের চুলার আগুনে পুড়েছে দুটি বসতঘর