প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৭ আগস্ট, ২০২৪ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

গত স্বাভাবিক হজ্বে অস্বাভাবিক মৃত্যু

বছরে ৫ দিনব্যাপী একবারই হজ্ব। হজ্ব পালনের খবরাখবর বিশ্বব্যাপী প্রচার পাবে স্বাভাবিক। গত হজ্বে ব্যতিক্রমধর্মী খবর হল স্বাভাবিক হজ্বে অস্বাভাবিক মৃত্যু। ৫ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে মাঝে মধ্যে ছোট বড় অঘটন হয়ে থাকে। যেমনআগুন লাগা, জামরাতে পাথর মারতে যেতে বা আসতে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়া ইত্যাদি। গত হজ্বে তা হয়নি। তারপরও ১৩ শতের অধিক হাজী মৃত্যুবরণ করেন। তৎমধ্যে ৬৫ জন হাজী বাংলাদেশী রয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০০ সালের আগে কোটা নির্ধারণ না থাকায় প্রায় ৩০/৩৫ লাখ বা তারও বেশি নরনারী হজ্ব করতেন বলে প্রচার রয়েছে। সৌদি সরকার ওআইসির মাধ্যমে সমঝোতায় বিশ্বব্যাপী প্রতি দেশে হাজারে ১ জন মুসলিম হজ্ব করার অনুমতি রয়েছে। এতে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে আসে। চলতি বছর ১৮ লাখ নরনারী হজ্ব করেছেন বলে জানা যায়। এতে হজ্ব অনেকটা নিয়মতান্ত্রিকে থাকারই কথা। ৫ দিন ব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে ১০ জিলহজ্ব অত্যধিক কষ্টসাধ্য আহকাম পালন করতে গিয়ে হজ্বযাত্রীর মৃত্যু হয় বলে আমার বিশ্বাস। এতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ কিছু কারণ আমার দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। যথা

. হেজাজ ভিত্তিক জজিরাতুল আরব। উষ্ণ মরুভূমি প্রবণ অঞ্চল। এখানকার বাসিন্দারা এ প্রতিকূল পরিবেশে অভ্যস্ত।

. তাদের শারীরিক গঠন অনেক শক্তিশালী, তেমনি শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে। অত্যধিক গরম তাদেরকে কাবু করতে পারে না। উপরোক্ত দুই কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হজ্বযাত্রীগণের শারীরিক সক্ষমতার উপর তাদের মধ্যে ধারণা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। মানুষ নিজেদের অবস্থার উপর অপরকে মূল্যায়ন করে। এটা অনেকটা মানবীয় চরিত্র।

. জামরাতে পাথর মারতে গিয়ে বিগত ১৫/২০ বছরের ব্যবধানেও একাধিক বার অঘটন ঘটেছে। পদদলিত হয়ে অনেক হাজী মারা গেছে। সেই জন্য সৌদি সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছিল যাতে মিনায় পুনঃ অঘটন না ঘটে।

. আরাফাত থেকে পায়ে হেঁটে মুজদালেফায় গমন করতে ব্যারিকেড দেয়া হয়। চট্টগ্রামের এক প্রসিদ্ধ কাফেলা আরাফাতে ঘোষণা দিয়েছেন বাসের স্বল্পতা রয়েছে। ট্রিপ দিতে হবে। অপরদিকে মুজদালেফা ৪/৫ কি.মি মাত্র। যারা যারা পায়ে হেঁটে যাবে তাদেরকে গাইড দিবে। ঐ কাফেলার একজন হাজী আমার বাসায় এসে স্ত্রীকে নিয়ে ব্যারিকেডে পড়ে লোমহর্ষক প্রতিকূলতার বর্ণনা দেন। হাজার হাজার হজ্বযাত্রী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে ব্যারিকেডে পড়ে। অতি পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে স্বামীস্ত্রী কোথায় যাবে, কোথায় বসবে, কোথায় মাগরিব এশা পড়বে, কোথায় রাত্রিযাপন করবে। শুধু তাই নয়, মৃত্যু যেন তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চট্টগ্রামের এই হাজী আমাকে হৃদয় বিদারক বর্ণনা দেন।

. ১০ জিলহজ্ব হজ্বের কষ্টসাধ্য আহকাম। পরপর ৪টি কাজ করতে হবে। সকল হাজী ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। বসে থাকলে চলবে না কাজ শেষ করতে হবে।

. মিনায় জায়গা সংকুলান না হওয়ায় দক্ষিণে মুজদালেফা এরিয়ায়ও তাঁবুর সম্প্রসারণ করা হয়। যেখানে লক্ষাধিক হাজী অবস্থান করছে। ৪৭/৪৮ ডিগ্রী তাপমাত্রা থেকে ৫০/৫২ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে অতি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে হজ্বের আহকাম শেষ করতে ৩/৪ কি.মি দূরত্বে পায়ে হেঁটে জামরার দিকে যেতে হচ্ছে পাথর মারতে। সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী আতঙ্কিত। তারা হজ্বযাত্রীর গতি জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড দিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে। যেন এক সাথে বেশি জমায়েত হতে না পারে। এতে লাখ লাখ হাজী অতি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ গরমের তাপে অসহনীয় হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর নির্দেশ দেয়া আছে হজ্বযাত্রীর গতি কমিয়ে দেয়া।

. জামরাতের দিকে যেতে হজ্বযাত্রীকে ভাগ করতে রাস্তা বাড়ানোর জন্য পূর্বপার্শ্বের রাস্তার দিকে দেড় ২ কি.মি ঘুরিয়ে দেয়। যাতে হাজীদের ভিড় কমে যায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। এতেও দেড় ২ কি.মি ঘুরে আসতে গিয়ে হাজীরা রাস্তার ধারে পড়ে যাচ্ছে। জামরাতের দিকে রাস্তা ভাগ করতে গিয়ে পূর্বপার্শ্বের রাস্তাটি পাহাড়ের উপর ঘুরিয়ে দেয়া। সেখানেও হজ্বযাত্রীরা রাস্তার ধারে ধারে পড়ে যাচ্ছেন। যা আমার বাস্তব দৃষ্টিতে পড়ে। অর্থাৎ ক্লান্ত দেহ নিয়ে অতি গরমে ব্যারিকেড আটকা পড়তে পড়তে রাস্তার ধারে ঢলে পড়তেছিল অসংখ্য হাজী। জামরাতের সেটে প্রবেশ করার সাথে সাথে তথায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। এখানে ২/৪ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে শরীরের জন্য সহায়ক হত। কিন্তু নিরাপত্তার কাতিরে কোথাও দাঁড়ানো যাবে না। উত্তর পার্শ্বে বড় জামরাতে ৭টি পাথর মেরে চলে যেতে হবে।

. বড় জামরাতে পাথর মারার পরপর হজ্বযাত্রীরা অনেকটা ২ ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবে। অত্যধিক ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে আসতে পারবে না। নিরাপত্তা বাহিনী ব্যারিকেড দিয়ে সিস্টেম করে রেখেছে জামরাতে পাথর মারার পর মাত্র একটা রাস্তা দিয়ে মিনার তাঁবুতে ফিরতে হবে। আর তা হবে সরাসরি মিনার তাঁবুতে ফিরে আসতে সকল হজ্বযাত্রীগণকে মুজদালেফার মাঠে মিনার তাঁবুর ওখানে ফিরে যেতে হবে। ওখান থেকে আবার জামরায় দিকে আসতে তাঁবুতে প্রবেশ করবে। এমন কি জামরার একদম নিকটে ১,,,,৫ সার্ভিস সেন্টার মোয়াল্লেম তাঁবুতে হাজার হাজার হজ্বযাত্রী রমি করার পর মাত্র ৪/৫ শ মিটারের মধ্যে তাদের তাঁবুতে ফিরে আসতে পারবে না। ঐ ৩/৪ কি.মি বা আরও বেশি দূরত্বে ঘুরে আসতে হবে। সৌদি হজ্ব কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা বাহিনীর যৌক্তিকতা হজ্বযাত্রীর নিরাপত্তা চিন্তা করে এসব করা হচ্ছে।

. ১০ জিলহজ্ব বড় শয়তানকে পাথর মারার পর আরেক ভাগ পবিত্র মক্কায় আসবে ৩ ভাগ হয়ে। একভাগ (.) আজিজিয়া হয়ে (.) বাস টার্মিনালের দিকে বাস পাওয়া যাবে কিনা সে লক্ষে (.) পায়ে হেঁটে।

বিশাল জামরার শেড পার হয়ে ৪/৫ শত মিটারের ব্যবধানে পায়ে হেঁটে কাবা শরীফে আসার শেড। এটা অনেকটা ৫ কি.মি বেশি দূরত্ব। এখানে সৌদি কর্তৃপক্ষের নেই কোন বসার ব্যবস্থা।

জিয়াদের দিকে তথা পবিত্র কাবার দিকে নবী পাক (.)’র জন্ম স্থানের এদিকে আসলে আগত যে কোন হাজীরা ভাগ হয়ে যায়। বামে জিয়াদ মিসফলার দিকে; ডানে ঘর্জা সামিয়ার দিকে। এখানেও নিরাপত্তা বাহিনী জিয়াদ, মিসফলার দিকে এ রাস্তাটা বন্ধ করে দেয়। তাদেরকে উত্তর দিকে ১ কি.মি এর কম বেশি ঘুরে মিসফলা ইব্রাহীম খলিল রোডের দিকে আসতে হয়।

১০. গত হজ্বে সৌদি কর্তৃপক্ষ খুবই কঠোর ছিল অনুমতি পত্র ছাড়া দেশবিদেশের যে কেউ যাতে হজ্ব করতে না পারে। সে লক্ষে গলায় ঝুলানো বড় আকারের ছবিসহ আইডি কার্ড দেয়া হয়। প্রায় ১৮ লাখ হজ্বযাত্রীর প্রত্যেকের এক রকম। যারা হজ্ব করবে না সেবক তাদের আরেক রকম। তারপরও আবেগপ্রবণ সাহসিকতার সাথে অনুমতির তোয়াক্কা না করে হজ্ব করেছেন এমন সংখ্যাও কম নয়।

বস্তুতঃ গত হজ্বের ১৩ শতের অধিক হজ্বযাত্রী মারা যাওয়ার পেছনের কারণ যারা অনুমতি না নিয়ে সরকারী সুযোগসুবিধা না পেয়ে অত্যধিক গরমে যেনতেন অবস্থায় হজ্ব করতে হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে মৃত্যু বরণ করেছেন। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে দায়ী করা যাবে। যারা সরকারীভাবে হজ্ব করেছেন এবং তাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এই মৃত্যুর জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতা অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করা যাবে। দায়ী করার ব্যাপারে পক্ষে যৌক্তিকতা হল

১১. আরাফাত থেকে পায়ে হেঁটে আসার সময় মুজদালেফার মুখে ব্যারিকেড দেয়া অকল্পনীয় অমানবিক। ব্যারিকেড দিতে গিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে।

১২. ১০ জিলহজ্ব মিনার তাঁবু থেকে বা পায়ে হেঁটে মুজদালেফা থেকে আগতদের জামরাতের দিকে যেতে ব্যারিকেড দেয়া অমানবিক।

১৩. ১০ জিলহজ্ব রমি করার পর মিনার তাঁবুতে ফিরে আসতে নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে কয়েক কি.মি ঘুরিয়ে দেয়া অমানবিক।

১৪. জুন মাসে হজ্ব হচ্ছে তাপমাত্রা অতি উচ্চ তা সৌদি কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা। তাদের সে লক্ষে মিনার হজ্বযাত্রীর আরামদায়ক ব্যবস্থা নেই বলে মনে করি।

(.) মাত্র ৫/৭ বর্গ মিটারের তাঁবুর শহর মিনা। এখানে ৪/৫ দিনের জন্য খোলা রাস্তাগুলো তাঁবু দিয়ে ডেকে দেয়া সম্ভব।

(.) রাস্তায় স্প্রে দিয়ে পানি ছিঠানো, জামরাতের মত এসি দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের ব্যবস্থা করা এ কালে সম্ভব।

(.) মিনা থেকে পায়ে হেঁটে শেডের ভিতর ঠান্ডা পানির বোতল দেয়া যেত। পানি দিয়ে স্প্রে এবং ঠান্ডা বাতাস দেয়া যেত।

মৌলিকভাবে সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার দু’টি দিক আমি উল্লেখ্য বলে মনে করি।

. যেনতেন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে হজ্বযাত্রীদের ঘুরিয়ে দেয়া।

. অত্যধিক তাপমাত্রা থাকবে জানা থাকার পরও হজ্বযাত্রীর যাতে গরম অনুভব না হয় তার ব্যবস্থা না করা।

আগেই উল্লেখ করেছি হজ্বযাত্রীর নিরাপত্তার কাতিরে ব্যারিকেড দেয়া হচ্ছে, ব্যারিকেড দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ১/২ কি.মি পথ ঘুরে আসার মত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হাজীদের সক্ষমতা আছে কিনা তা তারা ভাবেনি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআনোয়ারা গহিরা বখতিয়ার রোডে উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণ করা হোক
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে