আশুরার তাৎপর্য
মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরা। এই দিন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী। তৎমধ্যে অন্যতম হল কারবালা প্রান্তরে মর্মান্তিক হৃদয়বিদায়ক ঘটনা। যা ৬১ হিজরির ১০ মহররম তথা আশুরা’র দিন সংঘটিত হয়েছিল।
ঐতিহাসিক অনেক স্মৃতি বিজড়িত তাৎপর্যমূলক ঘটনাবলী কারবালা’র হৃদয়বিদারক ঘটনার কাছে ম্লান বলা যাবে। যা আজও উম্মতে মুহাম্মদীকে ব্যথিত করে চলেছে। এজিদ বাহিনীর জঘন্য তান্ডবলীলা আজও মুসলমানগণকে অশ্রু বিসর্জন করাচ্ছে। বিশ্বের ইতিহাসে এমন কোন ঘটনা– দুর্ঘটনা বোধ হয় নেই যা দিনের পর দিন মানব সন্তানকে এত অধিক পরিমাণ অশ্রু বিসর্জন করাতে সামর্থ্য হচ্ছে। শহীদগণের পিতা রসূলে খোদা (স.)’র নাতির পবিত্র দেহ থেকে যে পরিমাণ রক্ত কারবালা প্রান্তরে সে দিন প্রবাহিত হয়েছিল তার প্রত্যেকটি বিন্দুর পরিবর্তে দুনিয়ার মানুষ দুঃখ বেদনার মাতম অশ্রুর এক একটি সয়লাব প্রবাহিত করেছে। এ অশ্রুর সয়লাব বন্ধ হবার নয়। চলবে কিয়ামত অবধি। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কারবালার ঘটনায় মোট ৭২ জন শহীদ হন। ইহা এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা যে ইমাম হোসাইন (র.)’র ছোট কাফেলার মধ্যে অসুস্থ বালক ইমাম জয়নাল আবেদীন (র.) বাদে কোন পুরুষ জীবিত ছিলেন না। সবাই একে একে শহীদ হয়ে যান। এমন কি কারবালা প্রান্তরে জন্ম নেয়া ইমাম হোসাইন (র.)’র পুত্র সন্তান পর্যন্ত শহীদ হন এজিদ বাহিনীর হাতে। সীমার কর্তৃক ইমাম হোসাইন (র.)’র বিচ্ছিন্ন করা মস্তকমোবারকসহ মহিলাগণের কাফেলাকেও এজিদ বাহিনী নিয়ে যায় কুফাতে ওবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে।
কুফা প্রাচীন নগরী, কিন্তু আল মনছুর কুফা থেকে দজলা নদীর তীরে বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিল। কারবালা থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. দূরত্বে কুফা। এ ওবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ হল এজিদের দাদার দিক দিয়ে বাদী’র ঘরের নাতি। কুফায় ওবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের দরবারে ইমাম হোসাইনের মস্তক মোবারকের অসম্মান, সাহাবার কান্না হযরত ইমাম হোসাইনের সহোদর বোন সৈয়দা জয়নাবের তেজস্বী ভূমিকার কথা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।
ওবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ ইমাম হোসাইন (র.)’র মস্তক মোবারকসহ নবী পরিবারের সকলকে বন্দী অবস্থায় দামেস্কে এজিদের দরবারে পাঠিয়েছিলেন। আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.)’র আমলে দামেস্ক ইসলামের ছায়াতলে আসে। এজিদের পিতা আমিরে মুয়াবিয়া দামেস্কের গভর্নর হন। পরবর্তী আমিরুল মোমেনীন ওসমানগনি (র.)’র শাহাদাতের সাথে সাথে আমিরে মুয়াবিয়া নিজেকে গভর্নর স্থলে স্বাধীন রাজ্য শাসক হিসেবে এগিয়ে যেতে থাকেন। এতে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (ক.)’র সাথে আমিরে মুয়াবিয়ার মুখোমুখি যুদ্ধ, যুদ্ধে আমিরে মুয়াবিয়া পরাজিত হচ্ছেন দেখে কৌশল অবলম্বন করা হয়। সে এক ইতিহাস। আমিরে মুয়াবিয়া ইন্তেকালের সময় এজিদকে স্থলাভিষিক্ত করে যান। এ থেকে ইসলামের রাজতন্ত্রের সূত্রপাত বলা যাবে। এজিদ ইমাম হোসাইন (র.)’র কাফেলাকে পবিত্র মদিনায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ইমাম হোসাইন (র.)’র মস্তক মোবারক কোথায় সমাহিত তা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। এক বর্ণনায় ইমাম হোসাইন (র.)’র মস্তক মোবারক হযরত জয়নাব (র.)-কে দিয়ে দেন। তিনি কাফেলাসহ পবিত্র মদিনায় ফেরার পথে কারবালায় সমাহিত করেন। আরেক বর্ণনায় পবিত্র মদিনায় জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত করেন। অন্য আরেক বর্ণনায় এজিদ আহলে বায়েতের মহিলা ও শিশুগণকে পবিত্র মদিনায় পাঠিয়ে দেন এবং ইমাম হোসাইন (র.)’র মস্তক মোবারক দামেস্কে ওমাইয়া মসজিদের মাঠে সমাহিত করেন। পরবর্তীতে ঘটনা প্রবাহে মতান্তরে ওমাইয়াদের পতনের পর ইমাম হোসাইনের মস্তক মোবারক দামেস্ক থেকে ফিলিস্তিনের আস্কালন নিয়ে যাওয়া হয়। ক্রুসেডের যুদ্ধের সময় মস্তক মোবারকের মর্যাদা হানীর আশংকা করে আস্কালন থেকে ৫৪৮ হিজরীতে কায়রো নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিশ্বখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান (যেখান থেকে আল আজহার শুরু) মসজিদের কিছুটা দূরত্বে চত্বরে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে ইমামের মস্তক মোবারকের কারণে ইমামের মাজার সংলগ্ন আরেকটি প্রকান্ড মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যে সব রাজা–বাদশাহ, আমির ওমরাগণ ইমাম হোসাইন (র.) মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্সের সংস্কার এবং উন্নয়ন করেছেন তন্মধ্যে গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী অন্যতম। অপরদিকে কারবালায়ও ইমাম হোসাইন (র.)’র প্রকান্ড মাজার রয়েছে।
বিশ্বের ইতিহাসে ১০ মহররমে রয়েছে আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের কথা। অর্থাৎ ১০ মহররম একটি ঘটনা বহুল দিবস। যথা–রমজান মাসে রোজা ফরজ হওয়ার আগে ১০ মহররম রোজা রাখা ফরজ ছিল। এই দিন দুই হাজার নবী ভুমিষ্ট হয়েছিল এবং দুই হাজার নবীর দোয়া কবুল হয়েছিল, এই দিনই আল্লাহ পাক হযরত আদম (আ.) ও হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে পয়দা করেন। হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)’র তওবা কবুল হয় এই দিনে জমীনে প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয়। হযরত আইয়ুব (আ.) রোগ মুক্তি লাভ করেন। হযরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবনের পর জমীনে অবতরণ করেন। হযরত ইউনুচ (আ.) মাছের পেট থেকে উদ্ধার পান। হযরত মুসা (আ.)’র তাঁর সাথীদের নিয়ে বাহরে কুলজুম (লোহিত ও সুইস খালের মধ্যবর্তী স্থান) পার হয়ে যান; আর ফেরাউন দলবলসহ বাহরে কুলজুমে নিমজ্জিত হন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে নিস্তার পান। হযরত ইউসুফ (আ.) কারাগার থেকে মুক্তি পান। হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে উর্ধ্বাকাশে (বেহেশতে) উঠিয়ে নেয়া হয়। হযরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়। এ দিনই আল্লাহ পাক বিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং এ দিনই কিয়ামত হবে।
বিশ্বের ইতিহাসে ১০ মহররমের এসব ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহ কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার কাছে ম্লান। কারবালার এ মর্মান্তিক ঘটনা দামেস্কের উমাইয়া রাজ বংশের পতনের কারণ বলে ঐতিহাসিকগণ বলে আসছেন।
ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসে যে সকল শহর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, তন্মধ্যে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার পর কুফা ও দামেস্ক অন্যতম। তবে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার সাথে কুফা ও দামেস্ক সরাসরি জড়িত। পবিত্র মদিনা থেকে প্রায় ৯ শত কি.মি. উত্তর পূর্বে কুফা। ইরাকের পশ্চিমে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক পবিত্র মদিনা থেকে প্রায় ১৪৬৪ কি.মি. উত্তরে, কুফা থেকে ৬ শত কি.মি. পশ্চিমে। পবিত্র মদিনা, কুফা ও দামেস্ক এ তিন শহরকে যোগ করলে যে ভৌগলিক ত্রিভুজের সৃষ্টি হবে তার অন্তর্বর্তী তথা অভ্যন্তর ভাগের যাবতীয় স্থান বালুকাময় মরুভূমি ছিল। এ দুস্তর মরুভূমির ভিতর মানুষের বসতি ছিল বিরল। বিস্তীর্ণ মরুভূমি ধূ–ধূ করত। কদাচিৎ কোথাও দেখা যায় কোন প্রশ্রবণকে আশ্রয় করে খেজুর বীথিকার ছায়াতলে বহুকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেদুঈন পল্লী দারুণ খরদাহে ঝিমাচ্ছে। এই মরুভূমিই ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে গিয়ে মিশে গেছে। ফোরাতের শাখা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সেই বীভিষিকাময় প্রান্তর কারবালা। যে নদীর নামে আজও সারাবিশ্বের মুসলমানগণ শিহরিয়ে উঠে।
ইমাম হোসাইন (র.)’র সম্পর্কে নবী পাক (স.) এরশাদ করেন, “হোসাইন আমার থেকে, আমি হোসাইন থেকে, যে হোসাইনকে মহব্বত করবে, আল্লাহ তাকে মহব্বত করবে।” শুধু তাই নয়, আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর নাতি যাকে আনন্দ দানের জন্য স্বয়ং নিজে ঘোড়া সেজে পিঠের উপর চড়িয়ে নিতেন তিনি হচ্ছেন ইমাম হোসাইন (র.)। হযরত মা ফাতেমা (র.) বলেন, “ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন আলী (ক.) সাদৃশ্য হয়নি, আল্লাহর রাসূল নানা মুহাম্মদ (স.)’র সাদৃশ্য হয়েছেন।” মহান আল্লাহ পাক আমাদের অন্তরে আহলে বায়তের (নবী পাক (স.)’র পরিবার পরিজনের) প্রতি মহব্বত জাগরুক রাখুক। আমিন॥
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট