পিতার ইন্তেকাল পরবর্তী সন্তানের অনুভূতি
জীব তথা মানুষ মাত্রই মরণশীল। কিন্তু এ বাস্তব অনুভূতিটা মানবের মধ্যে কাজ করে খুব কম। মানব ভোগ বিলাসের পাশাপাশি দুনিয়ার চাহিদায় বিভোর হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। যৌবনকালে দাম্পত্য জীবনে পা বাড়িয়ে সন্তান লাভ করলে মন থেকে তাড়িত হয় সন্তানদের ভবিষ্যত কল্যাণে কি করা যায়। সন্তানের পিতারও পিতা মাতা রয়েছে। তাদের প্রতি সম্মানের পাশাপাশি দায়িত্ব পালনে অবহেলা আছে তা বলছি না। কিন্তু পিতা মাতার চেয়ে সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ অত্যধিক কাজ করে থাকে। তাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষাদান করার পাশাপাশি পিতার অবর্তমানে সন্তানেরা যাতে শান্তিতে আরামে থাকতে পারে, কোন রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন না হয়, সে লক্ষে একালে মনে করি পিতা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে।
সাধারণত মানবের দৃষ্টি নিচে দিকে থাকবে স্বাভাবিক। তথা পিতা–মাতার চেয়ে সন্তান–সন্তুতির দিকে থাকে তা ধ্রূব সত্য। সে জন্য মহান আল্লাহ পাক সন্তান–সন্ততির চেয়ে পিতা–মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অত্যধিক সজাগ থাকতে পবিত্র কুরআন মাজীদের মধ্যে দিক নিদের্শনা দিয়ে গেছেন।
সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল (স.) সন্তান সন্ততির চেয়ে পিতা–মাতার প্রতি দায়িত্ববোধ বহুগুণ বেশি তা বারে বারে উল্লেখ করে গেছেন।
আর তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, “তোমরা ইবাদত করবে না তিনি ছাড়া অন্য কারো এবং পিতা–মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। যদি তাদের একজন অথবা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের বলবে না ‘উহ্’ এবং তাদের ধমকও দিবে না এবং তাদের সাথে বলবে সম্মানসূচক কথা।
আর অবনমিত করবে তাদের জন্য নম্রতার বাহু বিনয়ের সাথে এবং বলবেঃ হে আমার রব! দয়া করুন তাদের প্রতি যেভাবে তারা আমাকে লালন পালন করেছেন শৈশবে।” (সূরা বনী ইসরাইল:১৭ঃ ২৩,২৪)
“আর আমি সদাচরণে নির্দেশ দিয়েছি মানুষকে তার মাতা–পিতার প্রতি। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে এবং দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। সুতরাং তুমি কৃতজ্ঞ হও আমার প্রতি এবং তোমার পিতা–মাতার প্রতি। আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।” (সূরা লুকমান:৩১ঃ১৪)
নবী পাক (স.) বলেন,“পিতা–মাতার খেদমতকারীর দোয়া আল্লাহ পাক কবুল করেন। নবী পাক (স.) আরও বলেন,“মহান আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দিতে পারেন, কিন্তু মা–বাবার অবাধ্যতার গুনাহ মাফ করবেন না আর অবাধ্যতার শাস্তি তার মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই দেয়া হবে। (মিশকাত)
কিন্তু আমরা বড্ড বেকুব। মনে করি পিতা–মাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ রয়েছে, আমরা করবই তো। আরেকটু গভীরে গিয়ে বললে পিতার প্রতি দায়িত্ববোধ অতিরিক্ত বিষয়। কিন্তু সন্তান–সন্ততিকে মানুষ করা, তারা যাতে কোন প্রকার প্রতিকূলতার সম্মুখীন না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সম্পদ বাড়ার জন্য রাখার জন্য, উপার্জন যেভাবেই হোক না কেন বিবেচ্য বিষয় নয়, অতি সাধারণ বিষয়।
মানুষ মরণশীল পিতা–মাতা ইন্তেকাল করবেন স্বাভাবিক। পিতা–মাতার কথা আমরা কয়দিন স্মরণ রাখতেছি। হয়ত সপ্তাহ পনের দিন বা মাস সর্বোচ্চ বছর।
পিতার ইন্তেকালে জানাজায় দাঁড়িয়ে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে কান্না জড়িত কণ্ঠে দুইটি বিষয় বলা হয়। ১। পিতার আচরণে কেউ কষ্ট পেলে ক্ষমা চাওয়া তা, সন্তান হিসেবে তা যথাযথ। ২। পিতার সাথে কারও কোন লেনদেন থাকলে সন্তান হিসেবে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি দিয়ে দিবেন। এ কথার বাস্তবতা কতটুকু। শতকরা কয়জন সন্তান পিতাকে দায়মুক্ত করতে অর্থ প্রদান করেন। তা দায়মুক্ত করবেনই না বরং উল্টো যারা চাইতে আসবে তাদের দেখলে বিরক্ত প্রকাশ করবে। আমার দীর্ঘ জীবনে এ রকম অনেক বিষয়ের সাক্ষী।
আবারও উল্লেখ করতেছি, পিতার ইন্তেকালের পর আবেগ অনুভূতি কাজ করে হয়ত সপ্তাহ পনের দিন বা বছরের অধিক সময় পিতা হারানোর উৎকণ্ঠায় আবেগওয়ালা সন্তান কয়জন পাওয়া যাবে। শতে ৫/৭ অথবা ৮/১০ জন পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল। বাস্তবতা বড় কঠিন!
মোবাইলের যুগ বর্তমান। পিতার ইন্তেকালের পরবর্তী পিতার মোবাইলটা কতদিন চালু রাখি! পিতার সন্তান হিসেবে তার মোবাইলের মাধ্যমে আমাদের কেউ খবর নিচ্ছে কিনা! পিতার কোন ব্যাপারে তার মোবাইলে কেউ কোন ফোন করতেছে কিনা, এই গুরুত্বটা আমরা কয়জনেই দিই। শুধু তাই নয়, পিতা ইন্তেকালে কিছুদিন যেতে না যেতেই এই মোবাইল আর চালু থাকে না। স্বভাবতই সন্তানের কাছে মোবাইলটা চালু রাখা বিরক্তিকর নয় কি!
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, কেউ ইন্তেকাল করলে সন্তান–সন্ততিরা শোকাহত থাকবে। নিকট আত্মীয় বা বন্ধু পিতার মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে তার ইন্তেকালের সংবাদটা প্রকাশ করা অতি অত্যাবশ্যক মনে করি। যেমন নরসিংদীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঢাকায় মতিঝিলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বিকেল বেলা ইন্তেকাল করেন। পরদিন দুপুরে জানাযা দাফন। কিন্তু ছোট ভাই ২ দিন পর ফোন করে আমাকে জানাচ্ছেন। যদি মরহুম ব্যক্তির মোবাইল থেকে ম্যাসেজটি সাথে সাথে দেয়া যেত, তাহলে আমি ঢাকা হয়ে নরসিংদী গিয়ে জানাজা দাফনে উপস্থিত হতে পারতাম। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে নরসিংদী গিয়ে যেয়ারত করে আসি।
এমইএস কলেজের ইংরেজি বিভাগের একজন অধ্যাপক তুরস্কের উপর আমার রচিত একটি গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন যা সর্বমহলে সমাদৃত হয়।
নির্লোভী নিরহংকারী এ রকম ব্যক্তি কম পাওয়া যায়। সকালে সংবাদপত্র উল্টায়ে দেখি তিনি ইন্তেকাল করেছেন। সকাল ৮ টায় এমইএস কলেজ মাঠে জানাযার পর লোহাগাড়া গ্রামের বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হবে। তাঁর মোবাইল থেকে ম্যাসেজটা দেওয়া হলে এমইএস কলেজে গিয়ে জানাযায় আমারও উপস্থিত থাকা যেত। অবশ্য তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যেয়ারত করা হয়। মোবাইলের প্রচলন হওয়ার পরও একালে যথাসময়ে সংবাদ না পেয়ে জানাযায় শরীক হওয়া যাচ্ছে না।
আমার জীবনে একাধিক ঘটনা ঘটেছে ইন্তেকাল হওয়া ব্যক্তির সংবাদ পাচ্ছি জানাযা দাফনের পরে। সন্তান যে পিতার প্রতি ইন্তেকাল পরবর্তী যথাযথ মূল্যায়ন দায়িত্বপালনে অস্বস্তিবোধ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সন্তানও ত একদিন বয়স হয়েই ইন্তেকাল করবেন। তখন তার সন্তানেরা তার প্রতিও অনুরূপ আচরণ করবে, এটাই বাস্তবতা, এটাই তিক্ত সত্য।
সন্তানের জন্যই তো হালাল–হারাম, ন্যায়–অন্যায় বিচার না করে সম্পদ দিয়ে যেতে জীবন কাটিয়ে দিলেন। এই সন্তানই ত আপনার ইন্তেকাল পরবর্তী আপনার থাকছে না। তাদের সন্তানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে দাঁড়াবে,এটাই বাস্তবতা।
একালে শতকরা ২/৪ জন পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল, যারা আয় রোজগারে সুন্দর পরিচ্ছন্ন। ঘুষ,দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাহাজানি, যেভাবে পারে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদ করতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইহাকে কোন পাপ বা অপরাধ মনে করছে না। বরং উল্টো শেষ বয়সে দাড়ি টুপি রেখে বেশি বেশি এবাদত করে, ঘনঘন হজ্ব ওমরাহ করে, লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ করে, দান খয়রাত দিয়ে, নিজেকে নিজে আল্লাহর অলি মনে করা হচ্ছে। তিনি জানেন এই সমস্ত সম্পত্তি তার সন্তানদের জন্য। কিন্তু ইন্তেকাল পরবর্তী সন্তানরা তার কোন কল্যাণ ত নয়ই স্মরণেও রাখবে না, এই অনুভূতিটা মহান আল্লাহপাকের মহিমা অন্তর থেকে উঠিয়ে নিয়েছে। হারাম টাকায় পুণ্য সওয়াব নেই বলতে কিছুই নেই। গভীর রাতে আমাদের এসব কিছু মন থেকে ভাবা দরকার।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক