প্রবাহ

তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের চট্টগ্রামের ইতিহাস জানতে আগ্রহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২২ মে, ২০২৪ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রদূত প্রথমবার চট্টগ্রাম সফরে আসলে গত ৬ মে অনারারী কনসাল জেনারেল আয়োজিত নৈশভোজে আমার কথার আলাপে রাষ্ট্রদূতের চট্টগ্রামের ইতিহাসশীপ ইয়ার্ড ইত্যাদি সংক্রান্তে জানার আগ্রহ অনুভব করি।

ঢাকায় রয়েছে তুরস্কের দূতাবাস। প্রতি ৩ বছর বা কম বেশি সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্রদূত পরিবর্তন হয়। ঢাকায় যোগদানের পর সুবিধাজনক সময়ে চট্টগ্রাম আসবে স্বাভাবিক। যেহেতু দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামে। ভৌগলিকভাবে ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে চট্টগ্রামের আলাদা ইতিহাস রয়েছে। তার উপর দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ চট্টগ্রামের কৃতি পুরুষ সালাহউদ্দিন কাশেম খান তুরস্কের অনারারী কনসাল জেনারেল।

বছর খানেকের ব্যবধানে রাষ্ট্রদূত পরিবর্তন হয়ে ঢাকায় যোগদান করেন রামিস সেন। গত ৬ মে সোমবার তিনি প্রথমবার চট্টগ্রাম সফরে আসেন। স্বভাবতই সালাহউদ্দিন কাশেম খানের বাটালী হিলস্থ বাসভবনে রাতের নৈশভোজের আয়োজন থাকে। ইতিমধ্যে অবশ্য তুরস্কের নৌবাহিনীর জাহাজ ‘টিসিজি কিনাল্লাদা’ চট্টগ্রাম বন্দরে ৩ দিনের সফরে আসেন। আর তা হল ৭৯ মে ২০২৪ ইং চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে অবস্থান করে। এই উপলক্ষে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত একদিন আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসেন। নৈশভোজে ১০/১২ জন অতিথির মধ্যে আমারও থাকার সুযোগ হয়। অবশ্য রাষ্ট্রদূতের সাথে বিগত তুরস্ক গমনের আগে দূতাবাসে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। গত বছর ২৩ অক্টোবর হোটেল শেরাটনে তুরস্কের শততম জাতীয় দিবস উপলক্ষে দাওয়াত পেয়ে আমারও উপস্থিত থাকা হলেও আলাপের সুযোগ থাকার কথা নয়। ৬ মে সোমবার অনারারী কনসাল জেনারেলের নৈশভোজে তিনি আমার মুখ থেকে চট্টগ্রাম বিষয়ে শুনতে আগ্রহ উপলব্ধি করি। সাথে সালাহউদ্দিন কাশেম খান এবং চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর রিয়াল এডমিরাল খন্দকার মিজবাহ্‌উলআজিম আলাপে আমার সহযোগী হন। মিজবাহ্‌উলআজিম চট্টগ্রামের জামাতা বিধায় তাঁর অনেক কিছু জানা। খাওয়া পর্বে যথেষ্ট সময় থাকায় অন্যান্য আলাপের চেয়ে তুরস্ক বাংলাদেশ সম্পর্কের পাশাপাশি ইস্তাম্বুল চট্টগ্রামের সম্পর্ক অত্যধিক গুরুত্ব পায়। যেহেতু তুরস্ক সুলতানগণের এশিয়ার আরব, আফ্রিকা এবং ইউরোপ মহাদেশের বিশাল অংশ তুরস্কের সুলতানগণের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মিশরের আলেকজান্দ্রেরিয়ায় তাদের নিজস্ব শীপ ইয়ার্ড ছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে নির্মিত শীপগুলি মজবুত টেকসই তদুপরি সস্তা বিধায় বিশ্বব্যাপী প্রচার ছিল। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি তুর্কি সুলতানগণের চট্টগ্রাম শীপ ইয়ার্ড থেকে শীপ কিনে নিয়ে যেত। ১৪৫৩ সালে সুলতান ২য় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুল জয় করেন। এতে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ২ শতের কম বেশি শীপ বসফরাস প্রণালী থেকে গোল্ডেন হর্ণে নিয়ে যায়। আমি রাষ্ট্রদূতকে যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করি তুরস্কের সুলতানগণ চট্টগ্রামের শীপ ইয়ার্ড থেকে শীপ কিনে নিতেন। নতুন শীপ পৌঁছে দিতে চট্টগ্রামের অভিজ্ঞ লোকজন এই শীপে থাকবে স্বাভাবিক। সুলতান ২য় মুহাম্মদ কর্তৃক ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামের নির্মিত শীপ যে ছিল না তা বলা যাবে না। সাথে সাথে এও বলা যাবে না ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামের লোকজন ছিল না। কর্ণফুলী নদী ও চট্টগ্রামে নির্মিত শীপ চট্টগ্রামের গর্ব, ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক। এ পরিচিতি কত হাজার বছর ধরে তা গবেষণার বিষয়। যেহেতু ঢাকার ইতিহাস মাত্র ৪ শত বছরের। চট্টগ্রামের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। তার মূলে চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থান। রাষ্ট্রদূত গত অক্টোবরে ঢাকায় তুরস্কের শততম প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে তুরস্কের ইতিহাস বলতে গিয়ে বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, সেল যুগ থেকে সুলতানী যুগ। সুলতানী যুগ থেকে প্রজাতন্ত্র যুগ।

খাওয়ার একাধিক গোল টেবিলের মধ্যে আমাদের টেবিলের ছিল মাত্র ৭ জন। তৎমধ্যে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রামিস সেন, আয়োজকঅনারারী কনসাল জেনারেল সালাহউদ্দিন কাশেম খান ও চট্টগ্রামে শুভেচ্ছা সফরে তুরস্ক নৌবাহিনীর ফ্রিগেট কমান্ডার এডমিরাল, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২ জন রিয়াল এডমিরাল খন্দকার মিজবাহ্‌উলআজিম ও মনিরুজ্জামান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম এবং আমি আহমদুল ইসলাম চৌধুরী। আমি আর সালাহউদ্দিন কাশেম খান বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২ জন রিয়াল এডমিরালকে আবদার রাখি, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে বিলুপ্ত চট্টগ্রামের শীপ ইয়ার্ড নিয়ে গভীর গবেষণাপর্যালোচনা করা চাই এবং এই শীপ ইয়ার্ডের ইতিহাস যাতে জনগণ জানতে পারে সেই ব্যবস্থাও করা হোক। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম আমাদের সমর্থন জানান।

প্রসঙ্গক্রম উল্লেখ করতে হয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। গ্রন্থটির নাম-The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760.

১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত উক্তগ্রন্থে চট্টগ্রাম এবং শীপ ইয়ার্ড বিষয়ে নানান কথা উল্লেখ রয়েছে।

অতএব, মোহরা কালুরঘাট এরিয়ায় বিলুপ্ত এবং চট্টগ্রামের গর্ব এই শীপ ইয়ার্ড নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারী পৃষ্টপোষকতায় বাস্তব ইতিহাস জনসাধারণের মাঝে প্রকাশ করা আবশ্যক মনে করি।

বস্তুতঃ কর্ণফুলী নদী কালুরঘাট মোহরা এরিয়ায় অনেকটা হালদা নদীর মোহনায় কর্ণফুলীর নদীর প্রশস্ততা অত্যধিক ছিল। চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর অরণ্য পাহাড়পর্বত নিয়ে। এখানে রয়েছে লাখ লাখ পরিচিত অপরিচিত পরিপক্ষ গাছ। গাছ কেটে কর্ণফুলী নদী পথে মোহরা নিয়ে আসা ছিল সহজ। ফলে এখানে শীপ ইয়ার্ড গড়ে উঠে। এখনও মোহরায়, কালুরঘাট এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে পাইলিং করতে গিয়ে ৭০/৮০ ফুট গভীরে গেলেও শক্ত মাটি পাওয়া যায় না এবং মাটির গভীর থেকে পতিত বড় বড় কাঠের অংশবিশেষ ও পাওয়ার কথা শুনা যায়। পাথরঘাটা শুলকবহর এসব সেকালকার নামগুলোর মধ্যে অনেক ইতিহাস রয়েছে। যা গবেষণার বিষয়।

নৈশভোজে যাওয়ার সময় প্রকাশিতব্য ‘সংবাদপত্রে তুরস্কের শত প্রবন্ধ’ গ্রন্থের পান্ডুলিপিটি সাথে করে নিয়ে যাই। প্রায় ২ শতের কাছাকাছি আকর্ষণীয় ছবি সম্বলিত গ্রন্থের কাজ সমাপ্তির পথে। যার পৃষ্টা সংখ্যা ৩৮৪। বয়সের কারণে গ্রন্থটি তৈরি করতে প্রায় বছরের কাছাকাছি সময় লেগে যায়।

সালাহউদ্দিন কাশেম খানের পিতা শিল্পজগতের প্রতিকৃৎ সাবেক এম.এন.এ ও মন্ত্রী এ.কে.খান। তার সাথে আমার পিতার অত্যধিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ফলে এই পরিবারের সাথে আমার ভাইদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও আমার সাথে সালাহউদ্দিন কাশেম খানের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে ২০১১ সাল থেকে। প্রথমবার তুরস্ক সফর করে আসার পর। ২০১১ সাল হতে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের সাথে সালাহউদ্দিন কাশেম খানের মাধ্যমে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তৎমধ্যেমুহাম্মদ ভাকুর এরকুল, হোসাইন মুফতুগুলু, ডেবরিন ওজতুর্ক, মোস্তফা ওসমান তুরান এবং বর্তমান রাষ্ট্রদূত রামিস সেন। গত ১৪ বছরের ব্যবধানে এই ৫ জন রাষ্ট্রদূতকে সালাহউদ্দিন কাশেম খানের বাটালী হিলস্থ বাসভবনে তুরস্ক বাংলাদেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি ইস্তাম্বুলচট্টগ্রামের সম্পর্কের কথা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরি। আমি চট্টগ্রামের সন্তান বয়স্ক একজন লেখক হিসেবে এ ৫ জন রাষ্ট্রদূতকে কৌতুহল দীপ্ত হয়ে আমার কথা শুনতে অত্যধিক আগ্রহ প্রত্যক্ষ করি। যেহেতু অন্যান্য অতিথিদের কথা আর আমার কথার প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন। অন্যান্যরা ব্যবসাবাণিজ্য তাদের প্রতিষ্ঠানাদি নিয়ে কথা বলে স্বাভাবিক। অপরদিকে আমার কথা হল, ইস্তাম্বুলচট্টগ্রামের শত শত বছরের সুসম্পর্ক এবং তার পেছনের যৌক্তিকতা নিয়ে। স্বভাবতই আমার কথাগুলি শুনতে প্রত্যেক রাষ্ট্রদূতকে কৌতুহলী হয়ে আগ্রহ প্রত্যক্ষ করি।

বস্তুতঃ তুরস্ক নৌবাহিনীর জাহাজ ‘টিসিজি কিনাল্লাদা’ তিনদিনের শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে আসে। এতে ইহা তুরস্ক বাংলাদেশ ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কের একটা দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল বলা যেতে পারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা
পরবর্তী নিবন্ধপলোগ্রাউন্ডের সামনের রাস্তা থেকে টিপ ছোরাসহ তিন যুবক গ্রেপ্তার