প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

স্মরণ : হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)
হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)। মহান অলি, আশেকে রাসূল; কাদেরিয়া ত্বরিকার শাইখ। তাঁর সাথে আমার একাধিকবার মোলাকাত করার সৌভাগ্য হয়। তিনি যখন পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্‌রাসা বা সংলগ্ন খানকায় তাশরিফ রাখতেন, তখন একাধিকবার তাঁর সাথে মোলাকাত হয়। ১৯৭৭/৭৮ সালের দিকে তাঁর সৌজন্যে বাঁশখালী হামেদিয়া রহিমা ফাজিল মাদ্‌রাসায় বৃহদাকারের একটি মাহফিল করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তখন বাঁশখালী শেখেরখীলের প্রখ্যাত আলেম হযরত আলী আহমদ রেজভীও তৎপর ছিলেন আমার সহযোগিতায়। কিন্তু হুজরের অতি ব্যস্ততায় তা সম্ভব হয়নি।
হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সিরিকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ইহা খায়বার পাখতুনখোয়ার প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ২/৩ ঘণ্টার রাস্তা। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে কোরআন মাজীদ হেফজ করেন।
ধর্মীয় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে তাফসীর, ফিক্বহ, নাহু, উসুল, মানতিক, আক্বাইদ, মারিফাতে বিজ্ঞ ছিলেন। ত্বরিকতের শিক্ষা দান তাঁর মহান পিতা থেকে। তাঁর ওস্তাদগণও পাকিস্তানের ধর্মীয় বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
মহান রবিউল আউয়াল মাসকে সামনে রেখে বৎসরে বাংলাদেশ সফর করতেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) জশনে জুলুসসহ বিশাল বিশাল মাহফিলে সদারত হিসেবে থাকতেন। এ মহান অলি ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ৭ জুন ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
তাঁর মহান দুই পুত্র। হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ ও হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ।
সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের উপদেষ্টা ছিলেন, ছিলেন খাইবার পাখতুন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। পিতার নিকট থেকে ত্বরিকতের শিক্ষা অর্জন করেন।
তাঁর সহোদর বড় ভাই হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহও একজন অলিয়ে কামেল, আশেকে রাসূল। তিনি পিতা ও দাদার রেখে যাওয়া ত্বরিকতসহ বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠানাদীতে খেদমত আনজাম দিচ্ছেন। পিতার নিয়মনীতিতে বাৎসরিক মহান রবিউল আউয়াল মাসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সফর করেন। মাঝে মধ্যে অন্য সময় আরেকবার বাংলাদেশে তাশরিফ রাখেন। তিনিও ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) জশনে জুলুস এবং বিশাল বিশাল মাহফিলে সদারত হিসেবে তশরিফ রাখেন।
আমারও তাঁর সাথে অনেক বার মোলাকাত করার সৌভাগ্য হয়। বিশেষ করে আমার ছোট ভাই সাবেক মেয়র ও এম.পি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর চট্টগ্রামের বাসভবনে এবং ছোট ভাইয়ের উদ্যোগে আমাদের বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে তশরিফ রাখেন হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ।
সম্ভবত ১৯৯০ দশকে হজ্ব উপলক্ষে হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ মক্কা মোকাররমার সামেয়াতে অবস্থান নেন। আমারও হজ্ব উপলক্ষে এ সামেয়াতে অবস্থান নেয়া হয়। ফলে হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ ছাহেবের সাথে নিয়মিত মোলাকাত হত।
হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র পিতা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ (রহ.)। আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলে ত্বরিকতে তথা ইসলামের বিশাল খেদমত করে গেছেন। সাথে সাথে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলেও ধর্মীয় নানান খেদমত রয়েছে তাঁর।
১৮৫৬ সালে পাকিস্তানের সিরিকোটে তাঁর জন্ম। কাদেরিয়া ত্বরিকার মহান শাইখ। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর অন্যতম খলিফা। তিনি সিরিকোটে প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষে তাঁর সহোদরের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকা গমন করেন এবং প্রতিষ্ঠিত হন। দক্ষিণ আফ্রিকার বড় বড় শহরগুলোকে জনগণের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছান। একাধিক মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। অসংখ্য মানুষকে তরিক্বতের দীক্ষা দেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মায়ানমার (বার্মা) গমন করেন। তথায় এক মসজিদের খতিব হিসেবে খেদমত করেন। সাথে সাথে ত্বরিকতের ও শরীয়তের আনজাম দিয়ে যেতে থাকেন।
তথা হতে তিনি শরীয়ত ও তরিক্বতের খেদমতের লক্ষ্যে আনজুমান-এ শুরা-ই- রহমানিয়া ধর্মীয় সুফি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান নাম আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। তিনি সেই সময় হতে চট্টগ্রাম সফর করেন।
ব্রিটিশ ভারতের সাথে আরাকানসহ মায়ানমারও ব্রিটিশের অন্তর্ভুক্ত। ফলে চট্টগ্রামের সাথে রেঙ্গুন ও আকিয়াবের নিয়মিত জাহাজ যাতায়াত ছিল। আকাশপথ উন্নতি লাভ করলে সেই পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম-রেঙ্গুন বিমান যোগাযোগ ছিল। ফলে তিনি নিয়মিত চট্টগ্রাম সফর করতেন। চট্টগ্রামেই তিনি প্রথম খানকাহ পরবর্তীতে মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের উপরতলা ভলুয়ারদীঘি পাড়ে খানকাহ ত্বরিকতের আলো বিকিরণরত স্থান বলা যাবে। পরবর্তীতে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্‌রাসা সংলগ্ন আলমগীর খানকাহ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, নূর মুহাম্মদ আল-কাদেরী, জাকের হোসেন কন্ট্রাকটর, হাজী ওয়াজির আলী সওদাগর, বাংলাদেশ প্রেসের আবদুল জলিল, আবু মুহাম্মদ তবিবুল আলমসহ চট্টগ্রামের অনেক বাঘাবাঘা ব্যক্তি তাঁর মুরিদ।
এ মহান অলি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। আমার ছাত্র জীবন; বাঁশখালী গ্রামের বাড়ী কেন্দ্রিক ছোট ছিলাম বিধায় এ মহান আশেকে রসূলের মোলাকাত থেকে বঞ্চিত হই।
হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ (রহ.) আমাদের দেশের চট্টগ্রাম থেকে ত্বরিকত কেন্দ্রিক শরীয়তের যে বীজ রোপণ করেন তা পরবর্তীতে তাঁর মহান সুযোগ্য সন্তান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) এবং তাঁরই মহান সুযোগ্য সন্তান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহর যোগ্য নেতৃত্বে আজ চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ ত্বরিকত কেন্দ্রিক শরীয়তের বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
যেমন- ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্‌রাসা। বিশাল এরিয়া নিয়ে একাধিক দৃষ্টিনন্দন বহুতল অবকাঠামো রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে। রয়েছে ৬/৭ হাজার ছাত্র। আরও রয়েছে মহিলা মাদ্‌রাসা, ঢাকা মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদ্‌রাসা। ঢাকা মহানগরীর বুকে কয়েক একর এরিয়া নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে মাদ্‌রাসা। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন একাধিক বহুতল ভবন। ঢাকার বুকে এ মাদ্‌রাসার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ট্রাস্ট পরিচালিত ৬০/৭০টি বিভিন্নমানের মাদ্‌রাসা ও মসজিদ রয়েছে।
আমি পাকিস্তান সফরকালে করাচি থেকে আকাশপথে লাহোর পৌঁছি। লাহোর থেকে সড়কপথে রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ যাওয়া হয়। যথোপযুক্ত সহযাত্রী ও যথাযথ তথ্যের অভাবে সিরিকোট যাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশ্য ভারতের উত্তর প্রদেশে দাদা পীর আজমগড়ী হযরতের যেয়ারত করে তথা হতে লক্ষ্ণৌ হয়ে বেরেলী যাওয়া হয় আলা হযরতের যেয়ারতে।
বস্তুত হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) এবং তাঁর মহান সন্তানাদি কাদেরিয়া ত্বরিকত ভিত্তিক সুফিজমে থেকে ইসলামের যে খেদমত করেছেন ও করছেন, তা স্মরণযোগ্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধউন্নয়নের কথা বলে সরকার বিভ্রান্ত করছে : ফখরুল