আমাদের জীবন জীবিকার চাহিদার অধিকাংশ প্রয়োজনীয় উপাদান দ্রব্য সামগ্রী অধিকাংশই আমদানি নির্ভর। বাংলাদেশ বহুল জনসংখ্যার দেশ। জনসংখ্যা অনুপাতে এ দেশে কর্মসংস্থান অপ্রতুল তাই শিক্ষিত অশিক্ষিত বেকারের বিরাট একটি সংখ্যা জাতির বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে শিল্প কলকারখানা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লক্ষ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছে যাতে বিদেশীদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প কারখানা বন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যুৎ গ্যাসসহ নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে। এ চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির আর একটি উৎস রেমিটেন্স। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সব প্রবাসী রয়েছে তার অধিকাংশই চট্টগ্রামের। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পেট্রো ডলারের দেশ মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দেশ থেকে অনেকে সে দেশে পাড়ি জমায়। ক্রমে প্রবাসীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ দেশে পাঠানোর ফলে জাতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে গ্রামীণ আর্থ সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। চট্টগ্রাম জেলার বিশেষ করে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, পটিয়া, ফটিকছড়ি এসব উপজেলার অধিবাসী প্রবাসে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সঙ্গত কারণে এসব উপজেলা শিক্ষা সংস্কৃতি চিকিৎসা যোগাযোগ ও অবকাঠামোগতভাবে অন্য এলাকা থেকে এগিয়ে। দীর্ঘদিন যাবত প্রবাসে অর্থ উপার্জনে থাকার সুবাদে অনেক প্রবাসী আর্থিকভাবে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি ব্যাবসা বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রবাসীদের অনেকে সে দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ দেশের গ্রামীণ আর্থসামাজিক জীবন ব্যবস্থায় পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী শিক্ষায় অনগ্রসর থাকার কারণে প্রবাসীদের অধিকাংশ সাধারণ বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। যথাযথ শিক্ষা, জ্ঞান, যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হলেও দেশে সে সব অর্থ বিনিয়োগ করার সাহস করে না। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ পারিবারিক ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুন্নয়ন খাতে অপচয় হয় বেশি। জ্ঞান ও মেধার অভাবে সঠিক সুষ্ঠু পরিকল্পনাহীনভাবে নানা খাতে অর্থ ব্যয়ে ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক নানা সমস্যার উদ্ভব ঘটে। সন্তানের পড়ালেখায় অত্যাধিক ব্যয় মেয়ে বা ছেলের বিয়েতে পারিবারিক সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় অপরিকল্পিত বাড়ি ঘর দোকানপাট মার্কেট শহর বন্দরে বহুতল ভবন নির্মাণ প্রতিযোগিতামূলকভাবে ধানী জমি ভিটাভূমি ক্রয় করার ফলে সমাজে অস্বাভাবিক একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। পেট্রো ডলারের কল্যাণে প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী অত্যাধিক মূল্যবৃদ্ধি যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চাঁদাবাজি, প্রশাসনিক ঘুষ, দুর্নীতি, শ্রমিক সংগঠনের প্রভাব গ্যাস বিদ্যুত পানি যোগাযোগ ব্যবস্থা অবকাঠামোগত প্রতিকূল পরিবেশের কারণে অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে শিল্প বাণিজ্যে বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চায় না। শিল্প প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শহর বন্দরে বাড়ি প্লট ফ্ল্যাট মার্কেট আবাসন প্রকল্পে পুঁজি বিনিয়োগ অধিক নিরাপদ ভেবে সে সব খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। প্রবাসীদের অনেকে উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা সামর্থ্য থাকলেও সরকার শিল্প বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় তাদের অনুপ্রাণিত করার প্রয়াস চালিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। রেমিটেন্স এক শ্রেণির প্রবাসীদের আরাম আয়েশ বিলাসী জীবন উপভোগের খাতে চলে যাচ্ছে। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈধভাবে দেশে পাঠালে তা যেমন নিরাপদ শুল্ক মুক্ত জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এ ধারণা ও সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ প্রবাসী অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোর ফলে জাতি রেমিটেন্স সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠানে রেমিটেন্স অর্থ বিনিয়োগের অভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে অলস পড়ে রয়েছে। রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া পথের হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের ১৮টি শাখা রয়েছে অথচ এখানে কোনো কলকারখানা শিল্প প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নেই যার কারণে এখানে অতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন। শুধু ব্যাংক ছাড়াও রয়েছে অনেক বীমা কোম্পানি বিভিন্ন অর্থ লগ্নকারি প্রতিষ্ঠান। এতগুলো ব্যাংক বীমা মাল্টিপারপাস কোম্পানির আর্থিক লেনদেনের প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। বিভিন্ন ব্যাংকে প্রবাসীদের কী পরিমাণ অর্থ অলস পড়ে রয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা জানি না। অনেক প্রবাসী সরকারি খাতে অধিক কর আদায় করে সি আই পি খেতাব অর্জন করেছে সরকার ও কর পেয়ে সন্তুষ্ট। দেশে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পাঞ্চল বিনিয়োগের অভাবে ভূমি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেদখল হয়ে যাচ্ছে এতে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্য দিকে দেশে বেকার সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ দেশে শিল্প কলকারখানা বৃহৎ মাঝারি ক্ষুদ্র পরিসরে স্থাপন করে বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে বেকার সমস্যার সমাধানে বিরাট ভূমিকা রাখবে এবং কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রবাসীদের অলস অর্থের সঠিক পরিসংখ্যা নিরূপণ করে তাদের শিল্প বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শিল্প বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি সুযোগ সুবিধা উপযুক্ত পরিবেশ প্রশিক্ষণ প্রণোদনা, ভূমি, বিদ্যুৎ গ্যাস, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চয়তা প্রদান করলে প্রবাসীদের মধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহ সৃষ্টি ও এ সংক্রান্ত তাদের নেতিবাচক ধারণা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি দেশে উদ্যোক্তা সৃষ্টির ভূমিকা রাখতে প্রবাসীদের রেমিটেন্স সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমৃদ্ধি অর্জনে সফলতা আসবে এতে সন্দেহ নেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক।