টালমাটাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিভাত। আত্মকর্মসংস্থান, অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশে জীবনযাপনের লক্ষ্যে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করছেন। প্রবাসীদের অতি কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মজবুত হয়েছে অর্থনীতির ভীত। দেশের শিল্পোন্নয়ন, জাতীয় উৎপাদন–বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অজর্নসহ বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাসে রেমিট্যান্সের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতির পাশাপাশি জনজীবনের মানোন্নয়নে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের জিডিপিতে ৬ থেকে ৭ শতাংশ অবদান রাখা এই রেমিট্যান্স পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য অংশীদার। করোনাকালীন অর্থনীতিতেও সমধিক উচ্চকিত ছিল এই রেমিট্যান্স। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান উৎস রফতানি খাত হলেও রেমিট্যান্স আয়ই সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের নবতর অধ্যায় নির্মিত হয়েছে।
১ জানুয়ারি ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাই–ডিসেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৯ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বিগত অর্থবছরের তুলনায় তা ২৯৭ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলার বা ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। তাছাড়া বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। পূর্বে ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রবাসীরা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডিসেম্বরে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৭২ কোটি ২০ হাজার মার্কিন ডলার। বিশেষায়িত ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক ও বিদেশি খাতের ব্যাংকের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ যথাক্রমে ১১ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার, ১৭৯ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার ও ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার।
৭ জুলাই ২০২৪ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা রেমিট্যান্স এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। যার পরিমাণ ৪৫৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। তাছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় আরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইতালি, কাতার, ওমান ও বাহরাইন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইতালি, কাতার, ওমান ও বাহরাইন থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ যথাক্রমে ২৭৯ কোটি ৩২ লাখ, ২৭৪ কোটি ১৫ লাখ, ১৬০ কোটি ৭৭ লাখ, ১৪৯ কোটি ৬৭ লাখ, ১৪৬ কোটি ১৬ লাখ, ১১৫ কোটি, ১১২ কোটি ৩৫ লাখ ও ৬৩ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু ২০২২–২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল সৌদি আরব থেকে। দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে আসা রেমিট্যান্সের মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২৬৮ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে ৭১০ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার ৪৩ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার ডলার এবং বিদেশি খাতের বাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৭ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে ২০২৪ সালে বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। উক্ত বছরে ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ১২৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়ে শীর্ষ স্থানে আছে ভারত। গত বছরের বৈশ্বিক রেমিট্যান্সের মধ্যে ভারতের হিস্যা ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে ছিল মেঙিকো। দেশটির প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় স্থানে থাকা চীনের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় নিয়ে চতুর্থ স্থানে থাকা দেশটি হলো ফিলিপাইন। তালিকায় অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে থাকা দেশসমূহ হলো মিসর, গুয়েতেমালা ও জার্মানি। ২০২৪ সালে মিসরের প্রবাসী আয় ছিল ২২ বিলিয়ন এবং অপর দুই দেশের ছিল ২১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ এবং ২০২৪ সালে গেছে আরো ৯ লাখ। উক্ত হিসাব মতে পাঁচ দশকের বেশি সময়ে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। যার বেশির ভাগই কর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশ সৌদি অরাব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহারাইন, লেবানন, জর্ডান ও লিবিয়ায়। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে।
আমাদের সকলের জানা, ছাত্র–জনতার অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থান সময়কালে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। প্রচন্ড পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দেশে না পাঠানোর জন্য তাদের আহ্বান ছিল যুগান্তকারী। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমন–পীড়নের প্রতিবাদে বিগত সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠানোর ঘোষণা দেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকার কয়েকটি দেশে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে সোচ্চার ছিল। বিক্ষোভের অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৭ বাংলাদেশীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়ার বিষয়টিও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রচিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নগতি পরিলক্ষিত হয়। গণমাধ্যম সূত্রমতে, ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৩ দিনে এসেছিল প্রায় ৯৮ কোটি এবং ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এসেছে প্রায় ৫৩ কোটি ডলার। ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমতে থাকে। সফলতার সাথে বিগত সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে নতুন সরকারকে শক্তিশালী করতে প্রবাসীরা আরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর ঘোষণা দেয়। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে অবৈধ হুন্ডি প্রথা অবজ্ঞা করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিভিন্ন বৈধ চ্যানেলে সরাসরি দেশে প্রেরণ করছেন। দেশ গঠনে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে অনেক প্রবাসী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। এর ফলে আবারও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার এবং সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। অক্টোবর মাসের ১৯ দিনে বৈধ পথে আসা ১৫৩ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স চমকপ্রদ অভিধায় পরিপুষ্ট। সরকার সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এর মধ্যে ডলারের দাম বৃদ্ধি অন্যতম। রেমিট্যান্সের বিপরীতে সরকারি খাতের আড়াই শতাংশ এবং ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে আড়াই শতাংশসহ মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বাড়লেও বর্তমানে তা কমেছে। মূলত এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, যদি ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের বিপরীতে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে সেক্ষেত্রে দেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় মাত্র ৬–৭ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু রেমিট্যান্স হিসেবে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠান তার বিপরীতে দেশের কোনো ব্যয় নেই। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পুরোটাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তাই প্রবাসীদের জন্য যত বেশি সুযোগ–সুবিধা বাড়ানো হবে দেশে তত বেশি রেমিট্যান্স আসবে। আর রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল থাকলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরী। দেশে তাদের পরিবার পরিজনের সুবিধার্থে নানাক্ষেত্রে অধিকতর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রত্যাশিত।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী।