প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক বিশ্বময়

ঝর্না বড়ুয়া | সোমবার , ৬ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

পালিতে ‘পবারণা’ শব্দ থেকে ‘প্রবারণা’ শব্দের উৎপত্তি। প্রবারণা শব্দের সার্বিক অর্থ প্রকৃষ্ট রূপে বরণ ও প্রকৃষ্ট রূপে বারণ। প্রকৃষ্ট রূপে বরণ বলতে, মানব জীবনের সত্য, সুন্দর, সততা, ন্যায়, ভালো, কুশল, উদারতা, গুণীজন প্রশংসিত ও কুশল কর্মকে বুঝানো হয়। আর অন্যদিকে বারণ বলতে, বরণের বিপরীত যা হলো অসত্য, অসুন্দর, অন্যায়, মন্দ, হীনম্মন্যতা, গুনীজন নিন্দিত ও অকুশল কর্মকে বুঝানো হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, প্রকৃষ্টরূপে সমস্ত অকুশল, মন্দ, অসত্য, অকল্যাণ, অন্যায়, অপরাধমূলক ও পাপ কর্মকে নিবারণ বা ত্যাগ করে সত্য, সুন্দর, সততা, মহান, ভালো ও কুশল কর্মকে গ্রহণ, ধারণ ও প্রতিপালনের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করাকে প্রবারণা বলা হয়। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ আমরা আধুনিককালে উন্নত চিন্তাচেতনা থেকে জানলেও সেই আড়াই হাজার বছরের অধিক কাল আগে মহাকারুণিক বুদ্ধ এই বিশেষ দিনে একে অপরের কাছ থেকে ঘটে যাওয়া দোষক্রটি, ভুল বোঝাবুঝির থেকে নিজেদের শুদ্ধি করাই এক মহামন্ত্র উচ্চারণ করেছেন ‘দোষ স্বীকার করার’ শুভক্ষণ হলো এই অনিন্দ্য সুন্দরতম দিন প্রবারণা। একে অপরের সাথে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে পারস্পরিক আলিঙ্গনে সমঝোতা, সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি ও মৈত্রীর সেতুবন্ধনে সমাজকে সংঘবদ্ধ করার অনন্য এক ঐক্যতার নাম প্রবারণা।

প্রবারণা বৌদ্ধদের কাছে এক মহাপবিত্রতম ও মহোৎসবের দিন। দীর্ঘ তিনমাস আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত দানশীলভাবনা ও শীলসমাধিপ্রজ্ঞার মহানব্রত পালন শেষে আশার আলো, ধর্মীয় শিক্ষার সমাপনী, মনের তুষ্টি, মানসিক প্রশান্তির পরিপূর্ণতার এক আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে এই প্রবারণা। তিনমাস সংযত, শৃঙ্খলা ও অনুশাসনের এই সময়টাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বর্ষাবাস বলা হয়। এই প্রবারনার দিনে ভগবান বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচারের ৪৫ বর্ষাবাসের মধ্যে ৭ম বর্ষা ব্রত পালন শেষে তাবতিংস দেবলোক হতে অন্যতম অপরিবর্তনীয় স্থান ‘সাংকাশ্য’ নগরে পদার্পণ এবং অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র মহাস্থবির মহোদয়কে ‘প্রজ্ঞাশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আশ্বিনী পূর্ণিমা বৌদ্ধবিশ্বে প্রবারণা পূর্ণিমা নামে সর্বাধিক পরিচিত।

একসময় ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর অনাথপিন্ডিক শ্রেষ্ঠী দানকৃত জেতবন বিহারে বসবাস করছেন। সেই সময়ে কিছু ভিক্ষুসংঘ কোশলরাজ্যে এক আবাসে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করেছেন। ঊনারা ধ্যান সাধনার অন্তরায় হবে মনে করে মৌনতা অবলম্বন করে কেউ কারো সাথে কথা বলতেন না। প্রয়োজনে ইশারা বা সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এভাবে বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি হলে জেতবন বিহারে তথাগত বুদ্ধকে দর্শনে ভিক্ষুসংঘগণ একসঙ্গে উপস্থিত হলে বুদ্ধ ভগবান কুশলাদি ও বর্ষাব্রত কেমন হলো জানতে চাইলেন। ভিক্ষুসংঘগণ বললেন, আমরা নিজেদের মধ্যে কোন কথা বলেনি, যদি বাক্য দ্বারা কোন অকুশল হয়, তাই মৌনতা অবলম্বন করে সম্যকরূপে ধর্মাচরণ সমাপ্ত করেছি। বুদ্ধ ভগবান ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এরূপ আচরণ প্রশংসার অযোগ্য, জ্ঞানের গভীরতা নেই, একসাথে থাকলে বাদবিবাদ ও মতের অমিল হতে পারে তারপরও আমরা মানুষ, আমাদের একে অপরের সাথে কথা বলতে হবে’। সেদিন থেকে তিনি ভিক্ষুসংঘগণের উদ্দেশ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করলেন,‘হে ভিক্ষুগণ বর্ষাবাস শেষান্তে বিভিন্ন দোষ ত্রুটি নিবারণের জন্য নিজেদের মধ্যে সখ্যতা রক্ষা করার জন্য স্বস্ব কনিষ্ঠতা ও জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী ক্ষমা প্রার্থনা করবে’। সেইদিন থেকে আজো বুদ্ধ ভিক্ষুগণ প্রবারনার দিনে সেই বিনয় কর্ম প্রতিপালন করে আসছেন। এমন আন্তরিক সখ্যতা ও সৌহার্দ্য শাসন সদ্ধর্মের উৎকর্ষতা, সুষ্টু, শ্রীবৃদ্ধি, ঐক্যতা অধিকতর সুদৃঢ়, সুন্দর ও মার্জিত করে তোলে। ভিক্ষুসংঘের ত্যাগময় জীবন আরো বেশি বীর্যবান, পরিশুদ্ধ ও নির্বাণমুখী সাধনামার্গে একাগ্রতা আনয়ন করে।

বৌদ্ধধর্মে কর্ম ও কর্মফলের উপর নির্ভর মানবজীবন। প্রতিটি মানবসন্তান জন্মের পর থেকে সংসার ধর্ম প্রতিপালনে সর্বদা ব্যস্ততম সময় পার করে। ঠিক তদ্রূপ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দেব মানবের কল্যাণে ধর্ম প্রচারে দিকবিদিক ছড়িয়ে পরতেন। পরহিত, পরকল্যাণ ও পরব্রতে উৎসর্গীকৃত জীবন এই মহান ভিক্ষুসংঘের। ভারত উপমহাদেশ ষড়ঋতুর সমাহার। বর্ষার মৌসুমে চারিদিকে জলাবদ্ধতা, জমির আইলে কর্দমাক্ত, মানবের গতিশীল জীবনে স্থবিরতাসহ চতুর্দিক বিবেচনায় ভিক্ষুসংঘের চলাফেরা দুঃসাধ্য ছিল। ভিক্ষুসংঘের আজকালকার মতো অধিক সংখ্যক চীবর বা পোশাকাদি ছিল না। তাই ঝড়বৃষ্টিতে চীবর ভিজে তাঁরা অসুস্থ, জীর্ণশীর্ণ হয়ে পরছে। অনেক সময় জমির আইলে চলাফেরা করতে গিয়ে ফসলের ক্ষতি হলে আবার পানি থেকে চীবর রক্ষা করার জন্য একটু হাঁটুর উপরে তুললে তাতেও মানুষরা ভিক্ষুসংঘের নিন্দাবাক্য বা সমালোচনা করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় বুদ্ধ প্রজ্ঞাপ্ত প্রদান করেন, প্রকৃতির বিরূপতা থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করার জন্য ভিক্ষুসংঘকে আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস এক স্থানে অবস্থান করে ধ্যান সাধনা অনুশীলনে নিজেদেরকে আত্মমুক্তির একাগ্রতা আনয়নে কিছু বিধি বিধান, নিয়ম নীতি ও বিনয় প্রতিপালনের উপদেশ বা নির্দেশ দিয়েছেন। এই ত্রৈমাসিক একাগ্রচিত্তে বর্ষাঋতু প্রতিপালনে নিয়ম নীতি ও বিনয় ধমের্র সমষ্টিরূপ হলো বর্ষাবাস বা বষাব্রত।

ভগবান তথাগত বুদ্ধ তাঁর দেবমানবের দুঃখ মুক্তির সত্যধর্মকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা পর ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস শেষান্তে। সমবেত ভিক্ষুসংঘকে উদ্দেশ্য করে তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমার মতো তোমরাও সর্বপ্রকার তৃষ্ণা ক্ষয় করে নির্বান উপলব্ধি করেছ। পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতিকে প্রকৃত মার্গের সন্ধান দেওয়া, দুঃখ থেকে মুক্ত করা এবং সদ্ধর্ম শ্রবণ করার সুযোগ করে না দিলে এই ভবদুঃখ থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। সুতরাং ‘চরথ ভিকখবে চারিকং, বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়, অত্থায় হিতায় সুখায দেবমনুস্‌সানং। মা একেন (মগ্‌েগন) দ্বে অগমিত্থ। দেসেথ ভিক্‌খবে ধম্মং আদি কল্যাণং মজ্ঝে কল্যাণং পরিয়োসান কল্যাণং। সাত্থং সত্যঞ্জনং কেবল পরিপুন্নং পরিসুদ্ধং ব্রহ্মচরিয়ং পকাসেথ’। বাংলা অনুবাদে বলা যায়, ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, জগতের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেবতা ও মানবের হিতকর ও সুখের জন্য। কিন্তু দুজন এক পথে যেও না। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা দেশনা কর, আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ ও অন্তে কল্যাণ। কল্যাময় শাশ্বত সদ্ধর্মের পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য জীবন প্রতিপালন করিবে’।

প্রবারণা পূর্ণিমার আরেকটি বিশেষত্ব হলো ফানুস উত্তোলন। ফানুসের আলোয় আলোকিত বিশ্বজগত। এই ফানুসের উৎপত্তি বিষয়ে বলা হয়, সিদ্ধার্থ গৌতম সেই আষাঢ়ী পূর্ণিমাতিথিতে গহত্যাগ করার প্রাক্কালে সত্যক্রিয়া করে স্বীয় মস্তকের কেশগুচ্ছ কর্তন করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি সত্যিই বুদ্ধত্ব লাভ করি তবে এগুলি আকাশে স্থির হবে অন্যতা ভূমিতে পতিত হবে’। অতঃপর সেই কেশগুচ্ছ উপরের দিকে উৎক্ষেপণে সত্যিই আকাশে স্থির হয়েছিল। এমন অসাধারণ পুণ্যময় দৃশ্য দর্শনে স্বর্গের অধিপতি দেবরাজ ইন্দ্র কেশধাতুকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় রত্নখচিত পাত্রে সুরক্ষিত করে ‘চুলামনি’ নামক চৈত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে পুজা বন্দনা ও অর্ঘ্য নিবেদন করে আসছেন। আবার বুদ্ধ ভগবান প্রবারনার দিনে স্বর্গীয় রতে চড়ে দেবমানবের পুষ্পবৃষ্টিতে তাবতিংস দেবলোক থেকে সাংকাশ্য নগরে পদার্পণ করেছিলেন। এই উভয় স্মৃতিময় ঘটনাকে সম্মান প্রদর্শন তৈল প্রদীপ সাদৃশ্য ফানুসের আলোতে চুলামনি চৈত্যের বুদ্ধের সেই কেশধাতুকে পূজা, বন্দনা ও অর্ঘ্য নিবেদন এই মহান পবিত্রতম সংস্কৃতি বৌদ্ধবিশ্বে যথাযোগ্য ধর্মীয় গারবতায় উৎসবে ও আনন্দে উদযাপন করা হয়।

প্রবারণা পূর্ণিমার পর কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাস যে বিহারে ভিক্ষু বর্ষাব্রত প্রতিপালন করেছেন সেসব বিহারে দানোত্তম, দানোরাজা ও দানশ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন হয়। এই দানোৎসব বর্তমান সময়ে মহাপুণ্যময় অনুষ্ঠান অনেকটা জ্ঞাতী সম্মেলনে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য পুণ্যার্থীরা আগত অনাগত মহান ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে ত্রিচীবর দান করেন এই দানানুষ্ঠানে। অন্যান্য দানের সাথে এই দানের পার্থক্য হলো মাত্র বছরে একবার তাও যে বিহারে ভিক্ষু বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করেছেন একমাত্র সেই বিহারে তা উৎযাপন করা হবে। এই দানের ফলও অপরিসীম।

পরিশেষে বলা যায়, ভিক্ষুসংঘ ও গৃহীসংঘের আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, ঋণপরিশোধ, ক্ষমা প্রার্থনা করার এক অভিনব, সুন্দরতম, আনন্দময় ও উদারতার আহবান জানিয়েছেন জগৎশ্রেষ্ঠ মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ। আসুন আমরা সকল ভুল ভ্রান্তি স্বীকার করে সমস্ত অনৈতিকতা পরিত্যাগ করে সত্য সুন্দর সততাকে বরণ করি বিনম্রচিত্তে একে অপরের কাছ থেকে বুদ্ধের নির্দেশিত উপদেশ অনুশীলন করি ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে। আমাদের অহং, মান, লোভ, দ্বেষ, মোহ সংবরণ করে ক্ষমা একমাত্র ক্ষমাই হোক মানবজীবনের মহান আদর্শ।

লেখক: প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন এনজিও কর্মী, লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্কুল হেলথ কার্ড চালু : ‘জনতার মেয়র’ ডাক্তার শাহাদাতের অনন্য উদ্যোগ
পরবর্তী নিবন্ধভাইরাল কৃষকের সঙ্গে জেমসের ছবি, জানা গেল পেছনের গল্প