বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্য নিয়ে আজ সোমবার চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার প্রধানের তিন দিনের এই সফরের বিস্তারিত তুলে ধরে গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, সেখানে প্রায় ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে এবং কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ঘোষণা হবে। অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ–চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি প্রভৃতি রয়েছে সমঝোতা স্মারকের তালিকায়। খবর বিডিনিউজের।
এদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়ে রাখলেও বাংলাদেশ এখন ভারতের প্রস্তাব নিয়েই ভাবছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় চীন চাইলে তবেই তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিস্তা নদী দুই দেশের যৌথ নদী, ভারত বাংলাদেশের যৌথ নদী। এই যৌথ নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারত একটি প্রস্তাব দিয়েছে এবং একইসাথে ভারত একটি কারিগরি দল পাঠাবে বলে আমাদেরকে জানিয়েছে। সমীক্ষার ব্যাপার আছে। ভারত প্রস্তাব দিয়েছে। যেহেতু যৌথ নদী, সেটি আমাদেরকে তো প্রথমে সেই প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে হবে, স্বাভাবিকভাবেই। চীনও এক্ষেত্রে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি খুব ভালো। যেহেতু ভারত প্রস্তাব দিয়েছে এটি ভালো দিক।
চীন থেকে বাজেট সহায়তা নেওয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাজেট সহায়তা নয় বরং চীনের সাথে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক খাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। চীনকে বাংলাদেশ অফশোর ব্যাংকিংয়ের প্রস্তাব দেবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অফশোর ব্যাংকিং ইজ ওপেন ফর অল। যে কোনো দেশ যদি চায়, আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাংকে চাইলে টাকা রাখতে পারে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ব্যাংকে অনেক দেশ টাকা রাখতে পারে। তবে অফশোর ব্যাংকিং কিছুটা ভিন্ন বিষয়।
মোংলা বন্দর উন্নয়নের বিষয়ে চীনের সাথে সমঝোতা হয়েছিল। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব চীনকে দেওয়া হবে কিনা, সেই প্রশ্নও রাখা হয় হাছান মাহমুদের সামনে। জবাবে মন্ত্রী বলেন, মোংলা বন্দর উন্নয়নের বিষয়ে চীনের সাথে আমরা আলাপ–আলোচনার মধ্যে আছি। এই সফরে আশা করছি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হবে। দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, চীনের সাথে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি থেকে আমরা আমদানি করছি বেশি, রপ্তানি কম হয়। আমাদের পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই চীনে সরকারি সফর করবেন। সোমবার বেলা ১১টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে তিনি দেশ ত্যাগ করবেন এবং একই দিন চীনের স্থানীয় সময় বিকাল ৬টায় বেইজিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন।
হাছান মাহমুদ বলেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অভ্যর্থনা জানানো হবে। পরদিন মঙ্গলবার সকালে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিন লিকুনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন সাং–গ্রি–লা সার্কেলে অনুষ্ঠেয় বাণিজ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। ওই সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশ থেকে একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল চীন সফর করবে।
ওইদিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রী চায়নিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসাল্টেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) চতুর্দশ জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। মঙ্গলবার বিকালে ঐতিহ্যবাহী তিয়েনআনমেন স্কয়ারে শ্রদ্ধা জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর রাতে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেবেন।
সফরের তৃতীয় দিন বুধবার চীনের স্টেট কাউন্সিলের প্রধান লি চিয়াংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলসহ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন। এরপর শেখ হাসিনা ও লি চিয়াংয়ের উপস্থিতিতে ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজের মধ্য দিয়ে গ্রেট হলে ওই সাক্ষাতের আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন হবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
১০ জুলাই বিকালে চীনের গ্রেট হলে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই সফর উপলক্ষে বাংলাদেশ ও চীন একটি যৌথ বিবৃতি দেবে। ১১ জুলাই বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে চীন ত্যাগ করবেন প্রধানমন্ত্রী। দুপুর ২টায় তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা।
১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর চীন সফর এবং পরে ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতির কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান আছে। ২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারত্বে উন্নীত হয়।
তিনি বলেন, গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হবার পর প্রধানমন্ত্রীকে চীনের পক্ষ থেকে সরকারি সফরের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ চীনের সহায়তা কামনা করবে। একই সাথে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ চীনের প্রতি সমর্থন প্রদান করে যাবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন।