প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর যা বললেন নেতারা

| সোমবার , ২৬ মে, ২০২৫ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে দলগুলো। গতকাল রোববার দুই দফায় ২০ জন রাজনৈতিক নেতার সাথে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

বিডিনিউজ জানায়, বৈঠক থেকে বেরিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বর্তমান সংকটপূর্ণ প্রেক্ষাপটে আমরা সবাই একমত যে একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট চলছে। প্রধান উপদেষ্টা বিশেষভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, ভারতীয় আধিপত্যবাদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনকে মানতে চায় নাবরং, সুযোগ পেলে একদিনেই আমাদের ধ্বংস করে দিতে চায়। এই উদ্দেশ্যেই তারা যা যা করা দরকার, তাই করছে। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত চিন্তিত। তার মতে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলাও জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দিনকে দিন সেই ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন।

তিনি বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে বলেছি, এই প্রশ্নে আমরা সবাই এক থাকব। প্রধান উপদেষ্টা খোলাখুলি কথা বলেছেন জানিয়ে মান্না বলেন, হঠাৎ করেই একদিন তিনি গভীর হতাশায় পড়ে যান; যখন উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে বৈঠক চলছিল, তখন তার মনে হয়েছিল, এতদিন ধরে তিনি যা যা করছেন, তার কিছুই সফল হবে না। সংস্কার হবে না, সুষ্ঠু নির্বাচনও সম্ভব হবে না। সেই হতাশা থেকে তিনি মনে করেছিলেন, তার আর দায়িত্বে থাকা উচিত নয়এজন্য তিনি পদত্যাগের কথা বলেছিলেন।

এ নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে মান্না বলেন, আমরা একটু রসিকতার সুরে বলেছি, এই উপদেষ্টা পরিষদকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ এখন জাতি চায় না যে ড. ইউনূস এভাবে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আমরা তাকে বলেছি, এখন তার আরও বেশি করে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। তাকে বক্তব্য রাখতে হবে, জনগণের সঙ্গে সংলাপে আসতে হবে। তিনি কী কর্মসূচি নিতে চান, তা স্পষ্ট করতে হবে। যেহেতু রাজনীতির মূল বিষয় এখন নির্বাচন, সেহেতু তার উচিত একটি স্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ উপস্থাপন করাকীভাবে তিনি নির্বাচন করতে চান, কবে সেটা করবেন, তা বলা জরুরি।

নিজেদের দলের অবস্থান সম্পর্কে মান্না বলেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কারআমরা চাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তার জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, ততটুকুই আমরা দাবি করি।

২০২৬ সালের জুনের আগেই নির্বাচন দেবেন প্রধান উপদেষ্টা : মামুনুল হক

বাংলানিউজ জানায়, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা ২০২৬ সালের ৩০ জুনের আগেই একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি দেশ ও জাতিকে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চান।

বৈঠকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করে। প্রথমত, চলমান রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে দৃশ্যমান অগ্রগতির অভাবের কথা তুলে ধরে দলটি। মামুনুল জানান, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, শাপলা চত্বরের ঘটনায় এবং অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা জানান, বিচার কার্যক্রম শিগগিরই দৃশ্যমান হবে বলে তিনি আশা করেন।

তৃতীয়ত, করিডোর ইস্যুতে দলের উদ্বেগ তুলে ধরা হলে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেন, কোনো ধরনের দেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে না এবং এ বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন দূর করতে ঘন ঘন সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরা হয়। মামুনুল জানান, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাও সম্মতি প্রকাশ করেছেন।

৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চায় এবি পার্টি

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বাসভবন যমুনায় বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা বলেন। মঞ্জু বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কেন পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে তিনি শঙ্কায় ছিলেন। আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব কমানোর জন্য সংস্কার ও নির্বাচনের কথা বলেছি। সেই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রজনতার সঙ্গে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছি।

. ইউনূস পরাজিত হলে আমরাও পরাজিত হব : চরমোনাই পীর

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করিম (চরমোনাই পীর) বলেছেন, আমরা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছি, আমরা দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম একটি সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। আপনি যদি পরাজিত হন, তাহলে আমরাও পরাজিত হব।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আপনাকে সহজভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমরা উনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, আপনি যদি পরাজিত হন, তাহলে আমরাও পরাজিত হবো। কিন্তু মাঝ পথে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।

নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার না হয়, তবে সামনে জাতীয় নির্বাচন কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হবে। এতে আগের কলঙ্কিত নির্বাচনের ইতিহাস ফিরে আসবেযা আমরা কোনোভাবেই চাই না। তিনি জানান, স্থানীয় নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব ঠেকাতে তিনি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

যত চাপ থাকুক ড. ইউনূসকে দায়িত্ব পালন করতে হবে : সাকি

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর যত চাপই থাকুক, তাকে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেছেন, . ইউনূসকে যেহেতু জনগণ একটা ভরসার জায়গায় রেখেছে, সে কারণেই তাকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। একদিকে হত্যাকারীদের বিচার এবং অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কারে যেতে হবে। এই দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে, অন্যথায় আর কোনো সুযোগ নেই।

সাকি বলেন, গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে জনগণের দৃশ্যমান বিচারের প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বিচার বিভাগকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, বিচারব্যবস্থা যেন দ্রুত ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এগিয়ে যায়।

গণঅভ্যুত্থান ভণ্ডুলের ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হচ্ছে : সেলিম

বিডিনিউজ জানায়, দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা জুলাই গণঅভ্যুত্থান ভণ্ডুলের ঘনীভূত ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, আমরা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক গতিধারা নিয়ে খোলামেলা আলোচনার চেষ্টা করেছি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এই উপলব্ধিতে এসেছি যে, বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি আমাদের গভীর নজর দেওয়া প্রয়োজন। দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে নানাভাবে গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হচ্ছে। যদি আমরা এসব ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারি, তবে তা হবে মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।

সেলিম বলেন, আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উঠেছে, বর্তমানে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জনগণের মনে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। এই বাস্তবতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। অতীতে রাজনৈতিক পতনের পর বিভিন্ন দল একত্রিত হয়ে যেভাবে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছিল, তেমনি এখন আবার আমাদের উচিত হবে যৌথভাবে একটি আচরণবিধি তৈরি করা। সেই আচরণবিধিতে আমরা প্রতিশ্রুতি দেব, রাজনীতিতে কিছু অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত কাজ আমরা আর করব না এবং যেন না হয় তা দেখার দায়িত্বও আমরা নেব। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনীতিকে একটি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিজেকেএসের ১৪ বিষয়ে তথ্য চায় দুদক
পরবর্তী নিবন্ধবিভাজন থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা