অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে প্রায় এক বছর পর আবার সিরিয়াল প্রথায় লাইটারেজ জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। নতুনভাবে গঠিত বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) থেকে গতকাল সোমবার সকালে আমদানিকৃত পণ্য খালাসের জন্য জাহাজ বরাদ্দ দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। প্রথম দিনে ২৮০টি জাহাজ সিরিয়ালভুক্ত এবং বহির্নোঙরে অবস্থানকারী ১৬টি মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাসের জন্য ৯৪টি লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) কার্যালয় থেকে আগের মতো জাহাজ সিরিয়ালভুক্ত এবং বরাদ্দ দেওয়া হলেও বলা হয়েছে, কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ সেক্টরের পাশাপাশি আমদানি বাণিজ্যে গতি আনতে কাজ করবে নতুন প্ল্যাটফরম। ইতোমধ্যে জাহাজ ভাড়া আগের চেয়ে গন্তব্য ভেদে ৫–৬ শতাংশ কমিয়ে নতুন ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বছরে প্রায় ১০ কোটি টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং হয়। গমসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি ক্লিংকার, পাথর, সার ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত নানা ধরনের খোলা পণ্যবাহী মাদার ভ্যাসেল বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। এসব মাদার ভ্যাসেল বহির্নোঙরে অবস্থান করে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে। মাদার ভ্যাসেল থেকে খালাস করে এসব পণ্য দেশের অন্তত ৩৬টি নৌ রুটে পরিবহন করা হয়। বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) সদস্য প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অন্তত ১৮শ বেসরকারি লাইটারেজ জাহাজ এসব পণ্য পরিবহন করে। তিনটি সংগঠনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য পরিবহন করা হতো। বেশ কয়েক বছর আগে থেকে সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে পণ্য পরিবহন করলেও ডব্লিউটিসির বিরুদ্ধে জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, জাহাজ বরাদ্দে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কার্যত ভেঙে যায় ডব্লিউটিসি। জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে বন্ধ হয়ে যায় সিরিয়াল প্রথা। প্রায় এক বছর ধরে জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকরা নিজেরা দর কষাকষির মাধ্যমে ভাড়া নির্ধারণ এবং জাহাজ ভাড়া করে পণ্য পরিবহন করছিলেন। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হয় এবং জাহাজ ভাড়া তুলনামূলকভাবে অনেক কমে যায়।
নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করলেও ভাড়া কমে যাওয়ায় সাধারণ জাহাজ মালিকদের অনেকে সংকটে পড়েন। জাহাজের ফিঙড অপারেটিং কস্ট যোগাতে সমস্যায় পড়েন অনেক জাহাজ মালিক। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ স্ক্র্যাপ করে ফেলেন জাহাজ। শ্রমিকদের বেতন–ভাতার যোগান আটকা পড়তে থাকে বিভিন্ন জাহাজে। অস্থিতিশীলতার মাঝে পুরো সেক্টরে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়।
বিষয়টি নিয়ে জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের শরণাপন্ন হলে সরকার এই সেক্টরে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নেয়। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর জাহাজ মালিকদের সংগঠনগুলোর নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে। সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনের আওতায় তিন সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল–বিডব্লিওটিসিসি। এই সেল থেকে সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে জাহাজ চলাচল করানোর বাধ্যবাধকতাও নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এক বছর পর গতকাল থেকে লাইটারেজ জাহাজের সিরিয়াল প্রথা পুনরায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গতকাল বিডব্লিউটিসিসিতে জাহাজ সিরিয়ালভুক্ত করা এবং বরাদ্দ দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। আগের মতো দেওয়া এই সিরিয়াল এবং বরাদ্দ নিয়ে সাধারণ জাহাজ মালিক ও আমদানিকারকদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। তাদের শঙ্কা, আবার সিন্ডিকেট তৈরি হলে সাধারণ জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আশ্বস্ত করা হয়েছে, কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। নিয়ম কানুন অনুসরণ করে জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হবে। সকল জাহাজ মালিক সমান সুযোগ–সুবিধা পাবেন। আমদানিকারকদেরও যৌক্তিক সুবিধা দেওয়া হবে।
এক বছর আগে ডব্লিউটিসি যে ভাড়া নির্ধারণ করেছিল এরপর জ্বালানি তেলের দাম ও শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। স্টাবলিস্টমেন্ট কস্ট বেড়েছে। কিন্তু এরপরও ডব্লিউটিসির চেয়ে গড়ে ৫–৬ শতাংশ ভাড়া কমিয়ে নতুন ভাড়ার চার্ট তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ কিংবা কাঁচপুর পর্যন্ত আগে প্রতিটন ক্লিংকার, জিপসাম, ইউরিয়া, লবণ, চিনি, গম, সোয়াবিন, কয়লা, পাথর পরিবহনে ভাড়া ছিল ৫৭৪ থেকে ৫৮৩ টাকা। তা কমিয়ে সকল পণ্যের জন্য একই ভাড়া ৫৫০ টাকা করা হয়েছে।
অন্যান্য গন্তব্যের ভাড়াও যৌক্তিকভাবে কমানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাহাজ মালিকদের সংগঠন আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ। তিনি বলেন, ভাড়া কমানো হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হবে দুর্নীতি প্রতিরোধ। এখনকার নেতৃত্ব কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমদানিকারকদের উদ্বেগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান নেতৃত্বের ওপর আমাদের আস্থা আছে।
গতকাল সকালে বার্থিং সভা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বিডব্লিউটিসিসির কনভেনর সাঈদ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও শিপ সুপারভাইজার মোহাম্মদ মনজুরুল কবির, বিডব্লিউটিসিসির ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির ও হাজী সফিক আহমেদ।
কমডোর মাকসুদ আলম বলেন, আগের তুলনায় জাহাজ ভাড়া আনুপাতিক হারে ৫ থেকে ৬ শতাংশ কমানো হয়েছে। আশা করি, ভাড়াসহ সিরিয়াল পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হবেন না জাহাজ মালিক ও আমদানিকারকরা।
তিনি বলেন, নৌপরিবহন সেক্টরকে নিরাপদ, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিরিয়াল প্রথা চালু করা হয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে জাহাজ মালিকদের পাশাপাশি আমদানিকারকরাও স্বস্তিতে ব্যবসা করতে পারবেন। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ রুট স্বাভাবিক ও নিরাপদ থাকলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
সাঈদ আহমেদ বলেন, এখানে কোনো কারচুপি থাকবে না, স্বজনপ্রীতি থাকবে না। এক কথায় এখানে কোনো সিন্ডেকেট গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হবে না। জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের জাহাজ সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে চলাচল করবে এবং কোনো জাহাজ বসে থাকবে না। সিরিয়াল অনুযায়ী সবগুলো জাহাজই ভাড়া পাবে। বন্দরে জাহাজের নিরাপত্তার স্বার্থে অননুমোদিত বাল্কহেড চলাচল বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।