সাগরের তলদেশে এবং মাটির নিচে পড়ে থাকা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) পাইপলাইন দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। কমিশনিং এবং পরীক্ষা–নিরীক্ষা সম্পন্ন হলেও পাইপলাইনটি চালু করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) এই পাইপলাইন কবে সচল হবে তা নিশ্চিত নয়। পাইপলাইনটি পরিচালনায় বিদেশি কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এই টেন্ডার প্রক্রিয়া ঠিকভাবে শেষ হওয়ার পর ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন হলেই কেবল পাইপলাইনটি চালু হতে পারে। প্রত্যাশার পাইপলাইনটি চালু না হওয়ায় দেশের জ্বালানি তেল লাইটারিংয়ের কাজটি এখনো ভাড়া করা জাহাজের ওপর নির্ভরশীল রয়ে গেছে।
বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর প্রায় ৯০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো বহির্নোঙরে অবস্থান করে। লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে এসব জ্বালানি তেল খালাস করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন নিজস্ব দুটি জাহাজ এ তেল লাইটারিং করছিল। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে দুটি অয়েল ট্যাংকার অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এগুলো বহর থেকে বাদ দিয়ে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করা হয়। ফলে চুক্তি অনুযায়ী তেল লাইটারিং করার জন্য বিএসসি বিদেশ থেকে ভাড়া করে একটি জাহাজ আনে। ওই জাহাজটি দিয়ে বর্তমানে আমদানিকৃত ফিনিশড ও ক্রুড অয়েল লাইটারিং করা হচ্ছে।
বহির্নোঙর থেকে গুপ্তাখাল জেটি পর্যন্ত জ্বালানি তেল লাইটারিং করতে বিপুল অর্থ খরচের পাশাপাশি প্রচুর সময়ও লাগে। এভাবে ১ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ খালাসে ১০–১১ দিন এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেলবাহী জাহাজ খালাসে ৪–৫ দিন সময় লাগে। এ পদ্ধতিতে জ্বালানি তেল খালাস সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় বড় জাহাজ থেকে সরাসরি তেল খালাসের জন্য ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে নেওয়া ওই প্রকল্পের মাধ্যমে গভীর সাগরে নোঙর করা বড় বড় মাদার ভ্যাসেল থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আনার ব্যবস্থা করা হয়। এতে একটি পাইপলাইনে ডিজেল এবং অপর পাইপলাইনে ক্রুড অয়েল আনার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কঙবাজারের মাতারবাড়ী দ্বীপের স্টোরেজ ট্যাংক থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সাগরে ভাসমান বয়াটির অবস্থান। ২২০ কিলোমিটার সমান্তরালে দুটি পাইপলাইনের সঙ্গে সেটি সংযুক্ত। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার পাইপলাইন অফশোর বা সাগরের তলদেশে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন অনশোর বা স্থলভাগে স্থাপন করা হয়েছে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যসের দুটি আলাদা পাইপলাইন ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত আনা হয়।
বড় জাহাজ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রথমে মহেশখালীর ট্যাংক টার্মিনাল, পরে সেখান থেকে পতেঙ্গায় তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংক টার্মিনালে নিতে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে। চীনের অর্থায়ন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে এসপিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটির কাজ শেষে কমিশনিং এবং পরীক্ষা–নিরীক্ষাও করা হয়েছে।
এই টার্মিনালটি ঠিকভাবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে পরিচালনার মতো লোকবল বিপিসির নেই। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড তিন বছরের জন্য এসপিএম পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনা হয়। কিন্তু এখন উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া কাজটি এভাবে দেয়ার সুযোগ না থাকায় তাদেরকে সরাসরি নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে এসপিএমও অচল হয়ে সাগর ও মাটির তলদেশে পড়ে রয়েছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বুঝে নিয়েছে। কিন্তু তাদের কাছে এটি পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ লোকবল নেই। তাই বিপিসি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আনার কার্যক্রম শুরু হবে।
বিপিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, পাইপলাইন পরিচালনার জন্য বিদেশি কোনো অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। ঠিকভাবে সবকিছু সম্পন্ন হলে সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হবে। এতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষার পাশাপাশি বিপিসির বছরে অন্তত ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।