চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সিটির মেয়রের মর্যাদাপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়ে রেজাউল করিম চৌধুরী মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এমন একটি সময়ে মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, যখন চট্টগ্রাম মহানগর শত সমস্যায় জর্জরিত। বিগত দিনে যারা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে আসীন ছিলেন তাঁরা নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে সফল হতে পারেননি। তাই বর্তমানের নির্বাচিত মেয়রের উপর থাকবে সচেতন নগরবাসীর সজাগদৃষ্টি এবং সতর্ক পর্যবেক্ষণ। অতীতের মেয়রদের পক্ষে যেসব কাজ সম্পন্ন করা যায়নি সেসব কাজের বা সমস্যার সমাধানের প্রত্যাশার ভারী চাপও তার উপর থাকবে।
বর্ষাকালে নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রত্যেক মেয়রের কমিটমেন্ট ছিল। কিন্তু অতীতের সকল মেয়রই এই কমিটমেন্ট পূরণে সফল হতে পারেননি। এছাড়া সামান্য বৃষ্টিতে নগরীর বেশ কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং আগ্রাবাদ এলাকায় বৃষ্টি ছাড়াও জোয়ারের পানিতে ঐ এলাকার পথ-ঘাট, বসতগৃহ প্লাবিত হওয়ার মত বিষয়গুলো দীর্ঘদিনেও সুরাহা না হওয়ার কারণে নিদারুণ দুর্ভোগ পোহানোর কষ্ট লাঘবের বিষয়ে চট্টগ্রাম নগরীর মানুষ এখন আর আশাবাদী হতে পারে না। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও চট্টগ্রামের লাইফলাইন নামে খ্যাত পোর্ট কানেকটিং রোড এবং আগ্রাবাদ-বাদামতলী থেকে বড়পোল পর্যন্ত সড়কের মেরামত কাজ শেষ না হওয়ায় এসব সড়ক ব্যবহারকারীরা সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এবং দীর্ঘদিনের এই ভোগান্তির কারণে তাদেরকে অতীতের সকল মেয়রদের সম্পর্কে ক্ষোভ ও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেঙ এবং আমতলাস্থ শাহ আমানত মার্কেটে আলো বাতাস চলাচলের জন্য যে সব ভেনটিলেশান পয়েন্টগুলি ছিল, সে সব স্থানে দোকান তৈরি করে আলো-বাতাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার মত বিষয়সমূহ মানুষের মধ্যে অতীতের মেয়রদের বিষয়ে সমালোচনার খোরাক যুগিয়েছে। ষোলশহর ২নং গেইটের কাছে অবস্থিত বিপ্লব উদ্যান একটি ঐতিহাসিক স্থান।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্য রাতে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই স্থানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল। অতি সাম্প্রাতিক সময়েও বিপ্লব উদ্যান অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ছিল। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ প্রতিদিন বিকালে এখানে বৈকালিক ভ্রমণে আসতেন। এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে মার্কেট নির্মাণ করে চসিক এই স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আবমাননা করেছে এবং এই উদ্যানের সৌন্দর্যহানি ঘটিয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কোন যুক্তিতে দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করা হল তা জানার হক নগরবাসীর আছে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিপ্লব উদ্যানে দোকান নির্মাণ করে বিক্রি না করলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এমন কি আর্থিক সংকট হত? চাক্তাই খালের কারণে দেশের বৃহত্তম পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকায় প্রতিবছর অল্প বৃষ্টিতে সৃষ্টি হওয়া প্লাবনে উক্ত এলাকার ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি এবং এসব এলাকার বসবাসকারীদের দুর্ভোগ-দুর্দশা ঘুচবে বলে এখন আর কেউ আশা করে না। নগরবাসীর মনে এই ধারনা বদ্ধমূল হয়েছে যে, এসব দুর্ভোগ তাদের কপালের লিখন এবং এসব থেকে তাদের মুক্তি নেই। চাক্তাই খাল এবং নগরে বেদখল হয়ে যাওয়া বড় নালা ও খালের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং এসব খালের খনন কাজ অনেক আগে শুরু হলেও এখনো শেষ করা গেল না। ডেঙ্গুর জীবানুবাহী মশার প্রবল উৎপাত এখনো বিদ্যমান। হোল্ডিং টেঙ এবং ভেলুয়েশন নির্ধারণকারী কিছু সংখ্যক সহকারী টেক্সেশন অফিসার ও কর আদায়কারীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নগরবাসীকে পেরেশানীতে রেখেছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে এখনো ওয়াসা, কর্ণফুলী গ্যাস, সিডিএ এবং চসিকের সমন্বয় নেই। পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি এবং সড়ক নির্মাণ বন্ধে চসিকের কোন ভূমিকা নেই। মেরিন ড্রাইভের নির্মাণ কাজও বন্ধ। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জাতিসংঘ পার্কটি চসিক এবং পূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এখন মাদকসেবী আর বেওয়ারিশ কুকুরদের দখলে চলে গেছে। জাতিসংঘ পার্কটি ছিল একসময় ঐ এলাকার ফুসফুস। প্রতিদিন বিকালে এই পার্কের ওয়াকওয়ে দিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ শরীর চর্চা ও হাঁটাহাঁটি করতেন এবং গাছপালা ও ফুলের বাগানে সমৃদ্ধ এই পার্কটি থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্য গ্রহণ করতেন। দীর্ঘদিন যাবত পরিত্যক্ত এই পার্কটির উন্নয়নে কোন উদ্যোগ আজও গৃহীত হল না। নগরীর জনবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহে এখনো পর্যাপ্ত সংখ্যক পাবলিক টয়লেট ও ব্রেষ্ট ফিডিং সেন্টার চালু করা করা গেল না।
নগরবাসী আরো আশা করছে যে, তিনি নগর পিতা নন, তিনি হবেন নগর সেবক, তিনি দলীয় মেয়র নন-তিনি হবেন সব নগরবাসীর মেয়র। নগরবাসী আশা করছে যে, তাদের সুষ্ঠু জীবন যাপনে মেয়র প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন, ভদ্র, বিনয়ী ও শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেবেন এবং নগর ভবনে আগত নাগরিকদের সাথে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্মানজনক আচরণ করবেন এবং তাদের প্রাপ্য সেবা পেতে সহযোগিতা করবেন। নগরবাসীর চাওয়া, নতুন মেয়র সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনে গতি সঞ্চার করবেন, তিনি আমলাদের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে আমলারাই তাঁর নিয়ন্ত্রণে থেকে তাঁর নির্দেশিত মতে কাজ করবেন। লেখক : সমাজকর্মী।