বিসিবি সভাপতির পদ নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে এসেছে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বক্তব্য। তিনি জানান, বিসিবি সভাপতি হিসেবে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা এবং ক্রিকেটের আশানুরূপ উন্নয়ন করতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে ফারুককে। খেলোয়াড়রা যেমন পারফর্ম করতে না পারলে বাদ পড়তে হয়, বিসিবি সভাপতির পদ থেকে ফারুক আহমেদের বিদায়কেও সেভাবেই তুলে ধরেন তিনি। জাতীয় পুরুষ হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গত তিন দিন ধরে দেশের ক্রীড়াঙ্গন উত্তাল করা ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদে নাটকীয় পালাবদল নিয়ে কথা বলেন তিনি। গতকাল শনিবার বিকেলে হ্যান্ডবলের আয়োজনে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হওয়ার পর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টাকে সব প্রশ্ন করা হয় ক্রিকেট বোর্ডের এই পরিবর্তন নিয়েই। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার দাবি, বোর্ড সভাপতি হিসেবে পারফরম্যান্স ভালো না করাতেই ফারুকের বিদায় ঘণ্টা বেজেছে। ‘প্রথমত, এটা যেভাবে যাচ্ছে এটা কোনো শাস্তি বা এরকম কিছু না। আমরা দেখেছি, বিগত ৯ মাসে বিসিবিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পরে যে প্রত্যাশা ছিল আমাদের, সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রিকেটের উন্নয়ন আমরা দেখিনি। এই সরকার আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সিরিজ জিতে এলো। তার পর থেকে আমরা ক্রমাবনতি দেখছি। খুবই দুঃখজনকভাবে, আমাদের যে নতুন নেতৃত্বে এসেছিল আমি তো ভাইয়া স্পোর্টসের মানুষ নই, ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে যাকে মনে করেছি তখন, সবাই যার কথা বলেছে তিনি ভালো চালাতে পারবেন, তাদেরকেই আসলে বোর্ডের বাকি সদস্যরা নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু বিগত সময়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, বিপিএল থেকে শুরু করে সর্বোপরি বাংলাদেশের ক্রিকেটের, আমাদেরকে তো বিচার করতে হবে পারফরম্যান্স দিয়ে, সেই পারফরম্যান্স আসলে আশানুরূপ নয়।’ বিসিবি সভাপতির সঙ্গে এখানে বাফুফে (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন) সভাপতির তুলনা টানলেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। তার মতে, ফুটবলে যেখানে নতুন জোয়ার এসেছে, সেখানে ক্রিকেটে এখন ভাটার টান। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা তুলে ধরলেন গত বিপিএলের নানা অব্যবস্থাপনায় ফারুকের দায় ও সমপ্রতি তার প্রতি আট বোর্ড পরিচালকের অনাস্থার ব্যাপারটিও। ‘বিগত সময়ের পারফরম্যান্সকে কেন্দ্র করে ও বিপিএলের যে সত্যানুসন্ধান কমিটি ছিল, তাদের রিপোর্টে আমরা দেখেছি, অনেকগুলো অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে বিপিএলে যেরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, আপনারাই রিপোর্ট করেছেন, সেগুলোতে মোটামুটি ফারুক ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এগুলোর বাইরেও আপনারা দেখেছেন, বিসিবির ৯ জন পরিচালকের মধ্যে ৮ জনই একটি অনাস্থা প্রস্তাব এনএসসিতে পাঠিয়েছে। এখানে কোনো টিম হয়নি আসলে। ক্রিকেটে যেমন ১১ জন মাঠে খেললে একটা টিম হয়, বিসিবিতেও তো টিম–আপের প্রয়োজন আছে।
বিসিবিতে ফ্যাসিবাদের সময় যারা ছিলেন, তারা ৫ অগাস্টের পরপরই পালিয়ে গেছেন, আপনারা জানেন। তার পরও বাকি যারা ৮–৯ জন পরিচালক আছেন, তারা কেউই উনার সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। এই পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি যে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ক্রমাবনতির পেছনে এটাও একটা কারণ। সেই জায়গা থেকে, বিসিবির আর্জি ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিপিএল সংক্রান্ত সত্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট, সবকিছু মিলিয়েই একটা সিদ্ধান্তে আমাদেরকে আসতে হয়েছে।’ ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের কিছু অভিযোগ নানা সময়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে উঠে এলেও তাকে সরানোর পেছনের সেসবের ভূমিকা নেই বলে জানলেন আসিফ মাহমুদ। ‘ফারুক ভাইয়ের সঙ্গেও ব্যক্তিগতভাবে আমার কথা হয়েছে। এমন নয় যে কোনো দুর্নীতির কারণে তাকে আমরা সরিয়েছি। এটা একেবারেই পারফরম্যান্সভিত্তিক। আপনারা যদি দেখেন যে, সিলেকশন বোর্ড যদি দেখে কোনো একজন ক্রিকেটার নিয়মিত খারাপ পারফরম্যান্স করছে, তাকে তো আর দলে রাখবে না। আমাদের দিক থেকেও ব্যাপারটি এরকমই ছিল। আমরা আবারও ক্রিকেটকেন্দ্রীক যারা অংশীজন আছেন, সকলের সঙ্গে কথা বলেছি।’ গত ২১ অগাস্ট ফারুক আহমেদ সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম তাকে কড়া সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল গত বিপিএলে নানা অব্যবস্থাপনা ও অসঙ্গতির কারণে। সেটিই বারবার তুলে ধরলেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। ‘আপনারা রিপোর্টটা সবাই দেখেছেন। রিপোর্টে খুব সুস্পষ্টভাবে সত্যানুসন্ধান কমিটি যে অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলেছে, বিপিএলের সদস্য সচিব ছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম ভাই (বিসিবি পরিচালক), উনারা উনাদের বক্তব্য সেখানে দিয়েছেন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকেও দুর্বার রাজশাহী দলটির ব্যাপারে, মানে যাদেরকে দল দেওয়া হয়েছে, আমরা আমাদের শঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম। তারপরও একক ব্যক্তি সিদ্ধান্তে সেই দলটা দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে ক্রিকেটারদের বেতন দেওয়া, হোটেলের টাকা দেওয়ার জন্য সরকারকে পর্যন্ত সম্পৃক্ত হতে হয়েছে। তখন একটা বিব্রতকর অবস্থা আসলে তৈরি হয়েছে, যেটা আমরা কেউই চাইনি। আমাদের সরকার প্রধানের বিপিএলের ফাইনালে থাকার কথা। কিন্তু বিপিএলকেন্দ্রীক এই পরিস্থিতির কারণে আমরা আনতে পারিনি, যেটা আমাদের জন্য, বোর্ডের জন্য লজ্জাজনক পরিস্থিতি।’
দায়িত্ব হারানোর পর ফারুক আহমেদ সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, অভিযোগগুলো নিয়ে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। সেটি নিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টার জবাব, ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সঙ্গে কথা বলেছি। তখন আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো কিছু তিনি আমাদের দিতে পারেননি।’ বিসিবি প্রধানকে এভাবে সরিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আগে কখনও ছিল না, তা মনে করিয়ে দেওয়া হলো উপদেষ্টাকে। তিনি দেখালেন নিয়মের পথ। ‘রেওয়াজ নেই আপনাকে দেখতে হবে সিস্টেমটা কী। যে দুজনকে মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার এনএসসির আছে, এনএসসি চাইলে মনোনয়ন দিতে পারে, মনোনয়ন সরিয়েও নিতে পারে। সেই জায়গা থেকে আমরা মনোনয়ন দিয়েছি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের মনে হয়েছে যে, এখন আর প্রয়োজন নেই মনোনয়ন রাখার।’ ‘আমরা কিন্তু সভাপতিকে অপসারণ করিনি, আমরা তার পরিচালক মনোনয়ন সরিয়ে নিয়েছি এবং এর প্রক্রিয়া হিসেবে, আফটার ইফেক্ট হিসেবে উনার সভাপতি পদ চলে গিয়েছে। আমরা আরেকজনকে পরিচালক মনোনয়ন দিয়েছি এবং বোর্ডের যারা আছেন, তারা আইসিসির গাইডলাইন অনুযায়ী ও ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, আরেকজনকে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করেছে।’ বিপিএলের অব্যবস্থাপনার কথা আবারও তুলে ধরলেন ক্রীড়া উপদেষ্টা। পাশাপাশি তার দাবি, স্রেফ ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ফারুকের মনোনয়ন সরিয়ে আমিনুলকে দায়িত্বে আনার ব্যবস্থা করেছেন তারা। ‘কে কী বলল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সত্যিটা কী। ফ্যাক্ট আপনারা দেখেছেন, আপনারা নিজেরাও রিপোর্ট করেছেন। বিপিএল নিয়ে স্পোর্টসের কোন সাংবাদিক রিপোর্ট করেনি? সেই অনুযায়ী আমরা সত্যানুসন্ধান কমিটি করেছি। আমি মনে করি, আপনাদের থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ মনে করে দেশের ক্রিকেট ভালো করুক। আমার ফোকাস হচ্ছে ক্রিকেট কীভাবে ভালো করবে, সেটার দিকে। কোন ব্যক্তিকে বসালাম বা কাকে, আমার ফোকাস সেদিকে নয়।’
‘এখানে আমিনুল ভাইকেও আমি চিনি না, ফারুক ভাইকেও চিনতাম না। আমি ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট দশজনের সঙ্গে কথা বলেছি, যাদেরকে মনে হয়েছে অংশীজন, তাদের মতামতের ভিত্তিতে ফারুক ভাইকে তখন এনেছিলাম। কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জায়গায় আমরা দেখেছি যে, সেভাবে কাজ হয়নি এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঐতিহাসিকভাবে তলানিতে চলে যাচ্ছে। এটা একটা কনসার্ন, একটা ন্যাশনাল কনসার্ন। এই জায়গা থেকে আমরা ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ফ্যাক্টগুলো বিবেচনায় নিয়ে আবার আমাদের জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ‘শুধু খেলোয়াড়রা পরিবর্তন হবে, তা তো নয়। যে পারফর্ম করতে পারবে না, আমি যদি পারফর্ম করতে না পারি, আমি ব্যর্থ হলেও আমিও পরিবর্তন হতে পারি।
প্রত্যেকটি জায়গাতেই ট্রান্সপারেন্সির জায়গা থাকা দরকার এবং প্রগ্রেসটা দেখা দরকার যে, ফেডারেশনগুলো কেন প্রগ্রেস করছে, কেমন কাজ করছে। আমি তো দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ডুবে যেতে দিতে পারি না। সেই জায়গা থেকে আমার যতটুকু এখতিয়ার আছে, নিয়ম অনুযায়ী, ততটুকু সবসময়ই চেষ্টা করে যেতে হবে।’ ফারুক আহমেদকে সরিয়ে দিলেও বছরের পর বছর ধরে বিসিবিতে থাকা কিছু পরিচালক এখনও আছেন বহাল তবিয়তে। তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে অসংখ্য। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে গঠনতান্ত্রিক অসহায়ত্বের কথা বললেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। তার আশা, আগামী অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন দিয়ে বিসিবিতে যোগ্য লোক আসবে।