বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রমতে, সম্প্রতি নতুন করে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। মিয়ানমার সামরিক জান্তার সাথে আরাকান বিদ্রোহীদের প্রচন্ড সংঘাত–সহিংসতা এবং রাজ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রোহিঙ্গারা অতিশয় আতঙ্কিত। বিগত ৭ বছর যাবৎ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থান দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। একদিকে নিজেদের মধ্যে হানাহানি–বিরোধের জেরে হত্যাকান্ডের ঘটনাসমূহে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো যারপরনাই বিপর্যস্ত। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলছে। জাতিসংঘসহ উন্নত দেশের অনেকের নানা উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন দৃশ্যমান নয়। তারা দেশে ফিরে যেতে উদগ্রীব বলে নানা বক্তব্য অবিরত শুনা যায়। এমনকি জান্তার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়ে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার দূরভীসন্ধিমূলক প্রতিশ্রুতিতেও তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কোনভাবেই কার্যকর মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ইতিমধ্যে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১২ হাজার রোহিঙ্গা সদস্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে।
অতিসম্প্রতি দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর’২৪ প্রদত্ত তাঁর অভূতপূর্ব ভাষণে বৈশ্বিক নানা সমস্যার বিষয় বিশ্বনেতাদের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। প্রাসঙ্গিকতায় তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিষয়েও তাঁর ও দেশবাসীর মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে। সাত বছর ধরে বাংলাদেশ মানবিক কারণে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। এর ফলে আমরা বিশাল সামাজিক–অর্থনৈতিক–পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে সৃষ্ট এই সংকট বাংলাদেশ এবং আমাদের অঞ্চলের জন্য প্রথাগত ও অপ্রথাগত উভয় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
উল্লেখ্য যে, একই দিন জাতিসংঘে ভাষণ প্রদানের পর প্রধান উপদেষ্টা ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্পর্কে তাঁর সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে খুব সম্ভবত তিনি মানবিক ও তাদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বলেছেন, ‘তারা যদি আসতে চায়, আমরা তাদের আসতে দেবো। আমরা তাদের গ্রহণ করবো।’
আমাদের সকলের জানা, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার পরিচালিত বর্বরতম অভিযানে নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় বার লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। সীমান্তবর্তী উখিয়া–টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ জীবন যাপনে মৌলিক চাহিদা পূরণসহ সামগ্রিক সার্থক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বপরিমন্ডলে বাংলাদেশ নতুন অধ্যায় নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি ব্যবহারকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নতুন আগমনে সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে; সঙ্কট নিরসনে তা এক ধরনের ধোঁয়াশা–প্রশ্নবিদ্ধ অন্তরায় বিবেচনায় সচেতন মহলে গভীর কৌতুহলের জন্ম দিচ্ছে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য; রোহিঙ্গা সঙ্কট ইতিমধ্যেই একটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এত বিশাল সংখ্যক বিদেশি শরণার্থীর কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান শুধু ঐ অঞ্চলে নয়; পুরো দেশেই অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্খিত দুরাশার দৃশ্যপট নির্মাণ করে। নিরাপত্তাজনিত–পরিবেশগত–নানামুখী অপরাধ সংঘটনে এই জনগোষ্ঠীর কদর্য কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় নিগূঢ় প্রতিবন্ধকতা পরিগ্রহ করেছে।
বাস্তুচ্যুত এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশে প্রতিনিয়তই নানামুখী সমস্যা তৈরি করে চলেছে। মাদক ব্যবসা ও সেবন–ডাকাতি–হত্যা–খুন–অপহরণ–মুক্তিপণ আদায়–আত্মকলহসহ দুঃসহ ঘটনায় পুরো কক্সবাজার জেলায় অস্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পাহাড়–গাছপালা কেটে তাদের অবস্থানের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অবৈধ ও অনৈতিক পন্থায় বাংলাদেশের পাসপোর্ট–জন্মনিবন্ধন–জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন সনদ সংগ্রহ করে বিদেশ গমন–নারী পাচারের হীন স্বার্থসিদ্ধিতে তৎপর রয়েছে। এসব উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলায় প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সময়ের আবর্তনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। অতি নগণ্য ঘটনা থেকে ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা।
অনিয়ন্ত্রিত অপরাধ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তার অভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা আতঙ্কে দিনযাপন করছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের অভিমত হচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সশস্ত্র দলগুলোর তৈরি করা ত্রাসের রাজত্বের কারণে সম্প্রতি ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ সংকটে রূপান্তরিত। ক্যাম্পের ভেতরে একটি পক্ষ অপরপক্ষকে কাফের বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সন্দেহ করে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অনেকে আছে যারা মিয়ানমার বাহিনীর কাছে তথ্য পাচার করে। তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথা না শুনলে পরিণতি হয় খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতর তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আধিপত্য বিস্তার– চাঁদাবাজি– পূর্ব শত্রুতার জের– মাদক– অস্ত্র ও মানবপাচারের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। ক্যাম্প এলাকায় গড়ে উঠেছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও অভিযানেও রোহিঙ্গাদের নানামাত্রিক অরাজকতা প্রতিহত করা অনেকটা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের এমন হীন–সহিংস কর্মকাণ্ড প্রশাসনের পাশাপাশি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদেরও আতঙ্কের কারণ হিসেবে প্রতীয়মান।
২ জুলাই ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি সূত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অপরাধ সম্পর্কে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ থানায় বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৬টি। তন্মধ্যে উখিয়া থানায় ২ হাজার ৪০৭টি এবং টেকনাফ থানায় ৯২৯টি। মোট মামলার ৬০ শতাংশের বেশি মাদক সংক্রান্ত। মাদকের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ২১টি। অবৈধ অস্ত্র ও গুলির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৭৬টি যা মোট মামলার ১১ শতাংশের বেশি। খুনের ঘটনায় মামলা রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খুনের বিপরীতে মামলা হয়েছে ২২০টি। এটি মোট মামলার ৭ শতাংশের সমান। এছাড়া অপহরণের ঘটনায় ১০৪টি এবং মারামারিতে ১২৯টি মামলা হয়।
উল্লেখ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লষণে প্রতিফলিত হয় যে, ২০১৭ সালে আশ্রয়শিবিরগুলোতে হত্যাকান্ডের ৮ মামলায় আসামি ছিল ২২ জন। ২০১৮ সালে ১৫ হত্যা মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ হত্যা মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ হত্যা মামলায় আসামি ২৩৭ জন এবং ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪০টি হত্যা মামলার আসামি ছিল ৪০৪ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুসারে, বিভিন্ন মামলায় কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলা থেকে যথাক্রমে ৮৫৮ ও ১৪ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়। একই তথ্যসূত্রে ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত ভাসানচর থানা আশ্রায়ন প্রকল্প–৩ এ ১০টি মামলায় ১৪ জন রোহিঙ্গা আটক হয়। এছাড়া কঙবাজারের উখিয়া থানাধীন ২৫টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে ৬২৮ জনকে এবং টেকনাফ থানাধীন ৮টি ক্যাম্প এলাকার মামলায় ২৩০ রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়।
মূলতঃ জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশ নানামুখী সংকট নিরসনে ইতিমধ্যে হিমশিম খাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে বাজারব্যবস্থায় কথিত সিন্ডিকেট কারসাজি এখনও প্রায় অনিয়ন্ত্রিত। ছাত্র–জনতার সার্থক গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পটভূমিতে দেড় হাজারের অধিক প্রাণ বিসর্জন ও অগণিত মানুষের পঙ্গুত্ব দেশসহ বিশ্ববাসীর হৃদয়ে অবিরাম রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। পক্ষান্তরে কতিপয় হিংস্র ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানের দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার অভিপ্রায় গভীর অনুভূত। এটি আকাঙ্ক্ষাকিত যে, সকল চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ লাঘবে অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংসকটসহ সকল সমস্যার আশু সমাধানে প্রায়োগিক কর্মকৌশল অবলম্বন করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়