প্রত্যন্ত দ্বীপের কাহিনি
রেজাউল করিম
বৈচিত্র্যপূর্ণ এই পৃথিবী। মানুষ পৃথিবীর কতটুকুইবা জানে। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ দ্বীপ রয়েছে। এমন এক দ্বীপ নিয়ে অবতারণা, যেখান থেকে সবচেয়ে কাছের দ্বীপের দূরত্ব ২ হাজার কিলোমিটার। যাতায়াতের একমাত্র উপায় মাছ ধরার বোট কিংবা ক্রুজ শিপ। আশ্চর্য মনে হলেও সত্য, এরকম এক দ্বীপে সেই ১৯ শতক থেকে বাস করে আসছে কিছু ব্রিটিশ নাগরিক এবং তাদের বংশধর। দ্বীপটির নাম ত্রিস্টান ডি কুনহা। বিবিসি জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রত্যন্ত দ্বীপ এটি। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে মাত্র ৯৮ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট এই দ্বীপ। প্রকৃতপক্ষে দ্বীপটি একটি আগ্নেয়গিরি হতে তৈরি। ১৯৬১ সালে এর উদগীরণের পর এখন এটি এখনো জীবিত।
সবচেয়ে কাছের দ্বীপটির দূরত্ব প্রায় ২১৬১ কিলোমিটার। সবচেয়ে কাছের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, যার রাজধানী কেপ টাউন থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৪৩২ কিলোমিটার। দ্বীপটি বর্তমানে ব্রিটেনের অধিকারে থাকলেও সর্বপ্রথম এটি আবিষ্কার করে ত্রিস্টাও ডি কুনহা নামক একজন পর্তুগিজ, ১৫০৬ সালে। একটি আগ্নেয়গিরির দ্বীপ ছাড়া একে এর বেশি কিছু ভাবেননি তিনি। ১৮১৬ সালে এটিকে অধিকারে নেয় ব্রিটেন। প্রথমদিকে মিলিটারি কাজে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে দ্বীপটিতে সাধারণ মানুষ এতে বসবাস করতে শুরু করে।
বর্তমানে আইল্যান্ড কাউন্সিল দ্বীপটিতে প্রশাসনিক কাজ করে আসছে। মূলত কৃষি পেশার সাথে তারা জড়িত। আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন দ্বীপ হওয়াতে এর মাটি চাষের উপযোগী এবং উর্বর। আলু এখানকার প্রধান কৃষিজ পণ্য। পাশাপাশি স্ট্রবেরি, পিচ অন্যান্য জিনিসও এখানকার অধিবাসীরা ফলিয়ে থাকেন। পশুপালন, খামার ইত্যাদির সাথেও তারা জড়িত যা থেকে অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় দুধ এবং ডিমের যোগান আসে। আর স্বাভাবিকভাবেই দ্বীপ হওয়ার কারণে এর মৎস্য সম্পদ বেশ সমৃদ্ধশালী। ত্রিস্টান ডি কুনহার বিখ্যাত ‘রক লবস্টার’ জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়ে থাকে।
পুরো দ্বীপে মাত্র ৯টি পরিবারের বাস। দ্বীপের জমির মালিক এই পরিবার, বাইরের কেউ জমি অধিগ্রহণ কিংবা কেনার অধিকার রাখে না। দ্বীপটিতে আছে চার্চ, স্কুল, হাসপাতাল, সুপারশপ, পোস্টঅফিস, কমিউনিটি হল, ক্যাফে ও মিউজিয়াম –সবগুলো একটি করে। সকল নাগরিক সুবিধাই এখানে বিদ্যমান।
১৯৬১ সালে আগ্নেয়গিরির উদগীরণের কারণে দ্বীপের অধিবাসীদের দুই বছর ইংল্যান্ডে বসবাস করতে হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এখানকার অধিবাসীরা আবার ফেরত আসে। এখন পর্যটকরা চাইলে আগ্নেয় পাহাড়ে হাইকিংয়ে যেতে পারে। ২০১৩ সালে সেখানে একটি পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৬১ সালের স্মৃতির কথা স্মরণ করে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ভলকানো পার্ক ৬১।
বৈচিত্র্যে ভরা দ্বীপটিতে প্রাণিবৈচিত্র্যও আছে। পেঙ্গুইন, এলব্রাটস, সিল, তিমি ছাড়াও নানা ধরনের জীবের দেখা মেলে। একটি মাত্র বাস চলাচল করে দ্বীপটিতে। চাইলে যে কেউ বাসে অথবা পায়ে হেঁটে পুরো দ্বীপ ঘুরতে পারে। মাঝে বিশ্রামের জন্য আছে রাস্তার পাশে বেঞ্চ। পেছনে পাহাড় সামনে উত্তাল আটলান্টিক আর কোলাহল ও যান্ত্রিক শব্দ মুক্ত পরিবেশের টানে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ত্রিস্টান ডি কুনহায় চলে আসে। তবে এ দ্বীপে যাওয়া যেমন কঠিন, তেমনই এখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়াও কঠিন। প্রথমে জাহাজের সময়সূচি মাথায় রেখে আবেদন করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছরও তা করা লাগতে পারে। এরপর প্রয়োজন রাতযাপনের স্থান নিশ্চিত করা। স্থানীয় অধিবাসীদের কোনো বাসা, গেস্ট হাউজ অথবা মিউজিয়ামে পর্যটকরা থাকতে পারেন। তবে গেস্ট হাউজে নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। এরপর অনুমতিপত্র। যাত্রার আগে প্রশাসনিক সচিবের কাছে ভ্রমণকারীর নাম, বয়স, জাতীয়তা, ভ্রমণের তারিখ এবং উদ্দেশ্য ইত্যাদি জানিয়ে মেইল পাঠাতে হয়। প্রয়োজনবোধে স্থানীয় প্রশাসন ভ্রমণকারীর ক্রিমিনাল রেকর্ডও চাইতে পারে।
শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যদি হাঁপিয়ে উঠেন তবে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ দিতে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবস্থা। এরমাঝে হাইকিং, গলফ, বোট ট্রিপ ইত্যাদি। তাছাড়া কুইন মেরি’স পিকে রয়েছে হার্ট আকৃতির লাভ লেক, যা ২০৬২ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।
অ্যানসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, গফ এবং দুর্গম দ্বীপগুলি একসাথে একটি বন্যপ্রাণি সংরক্ষণাগার গঠন করে, যা ইউনেস্কো ১৯৯৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মনোনীত করেছে। এটা পৃথিবীর প্রত্যন্ত একটি এলাকা। সংক্ষেপে টিডিসি নামে পরিচিত। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে ত্রিস্তান ডি কুনহা দ্বীপে অধিবাসীর সংখ্যা ২৪৫। তাদের মধ্যে ১৩৩ জন নারী এবং ১১২ জন পুরষ। তারা সবাই সেভেন সিজের এডিনবরায় বাস করেন। এই দ্বীপটি ব্রিটেনের বাইরে ব্রিটিশ–শাসনাধীন এলাকা।