দেহ একটি সিস্টেম। এই সিস্টেমের অংশ হলো পাঁচটি সাব–সিস্টেম। রক্ত পরিবহনতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র। প্রতিটি তন্ত্র এদের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করলে, এই তন্ত্রের সম্পর্কের ফল, দেহ বা দেহ নামের সিস্টেমটি সুস্থ থাকে। যদি কোন একটি তন্ত্র যথাযথ কাজ না করে, তাহলে অন্য তন্ত্রের উপরও তার প্রভাব পড়ে। এবং শেষমেশ অন্য তন্ত্রগুলো ও ম্যালফাংশন করতে শুরু করে। দেহ নামের সিস্টেমটি সংকটে নিপতিত হয়।
সংকট তা হোক প্রকৃতির বা সমাজের, তার মৌলিক কারণ হলো সিস্টেমের অংশের উপাদান এর ম্যাল ফাংশনিং ও সিস্টেমের ডিসইন্টিগ্রেশন। এতে ধসে পড়ে সিস্টেম, এর অর্থ হলো এর অন্য উপাদানগুলো কাজ করছেনা। পরিবেশ দূষণ মূলত ইকো–সিস্টেমের মৃত্তিকা মন্ডল,বায়ু মন্ডল, বারি মন্ডল বা অন্য কোন মন্ডলের অকার্যকারিতার ফল ও তো সহজ কথায়, সংকটের মূল কারণ, সিস্টেমের যেকোন অংশের অকার্যকারিতা।
সমাজে হাজারো, প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সমিতির সম্পর্কের ফল। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজের মৌলিক পাঁচটি কাজের উপর ভিত্তি করে সমাজ–সিস্টেমের প্রতিষ্ঠান নির্দেশ করেন। অর্থনীতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, বিনোদন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক হচ্ছে সমাজের সিস্টেম। সমাজের অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠানের একটিও যদি ঠিকমত ফাংশন না করে, তাহলে পুরো সিস্টেম তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। মনে করি কোন সমাজের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ঠিকমত কাজ করছেনা অর্থাৎ সমাজে উৎপাদন ও বণ্টন যথাযথ হচ্ছেনা। বেকারত্ব, অর্থনৈতিক দুর্গতি অপরাধ প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেবে, শেষতক শিক্ষা ব্যবস্থাও হবে আক্রান্ত। অংশের অকার্যকারিতা, সমগ্র অস্তিত্বকে বেসামাল করে দেয়।
সমাজে অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন রয়েছে। কোনটা ব্যবসায়িক, কোনটি বিনোদনের আবার কোনটি শিক্ষা সংক্রান্ত। শিক্ষা এক মৌলিক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা ছাড়া কোন অর্থনৈতিক বা অন্য কোন কাজ কখনোই সম্পন্ন হবেনা। তাই শিক্ষা উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মানুষ প্রকৃতিকে জানে এবং একে বদলায়, পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণী তা জানেনা। আর এই বদলানোর কাজটি মানুষ শুধুমাত্র প্রকৃতির গঠন ও পরিবর্তনের নিয়ম জেনেই করতে পারে। আর নিয়ম জানাই হচ্ছে–শিক্ষা। শিক্ষা হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক। সমাজ ও সভ্যতার উদ্ভবের কালে, শিক্ষা ছিলো অপ্রাতিষ্ঠানিক কিন্তু সমাজের পরিবর্তন ও প্রযুক্তি নির্ভরতা মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে এসেছে। শুধু প্রকৃতিকে জানা নয়, প্রকৃতিকে বদলানোর যে হাতিয়ার বা প্রযুক্তি তৈরি করেছি, তা পরিচালনার জ্ঞান ও আমাদের শিক্ষা নিতে হচ্ছে। প্রযুক্তি নির্ভর দুনিয়ায়, জ্ঞানহীন থাকা একেবারেই অসম্ভব।
প্রশ্ন হলো, এই জটিল গ্রন্থিবদ্ধ সমাজে শিক্ষা দেয়া হয় কি ভাবে? সমাজের হাজারো গ্রন্থিবদ্ধ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর নির্দিষ্ট কাজের পরিচালনার মাধ্যমে সমাজ সচল থাকে। এর মাঝে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধ কর্ম সম্পাদনের উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শিক্ষককে জাতির মেরুদন্ড বলা হলেও, শিক্ষা হচ্ছে সমাজ–অর্থনীতির মেরুদন্ড। এই মেরুদন্ড শক্ত হবে, যদি শরীরের অন্যান্য গ্রন্থিবদ্ধ অংশগুলো প্রয়োজনীয় রসদ যোগান দেয়।
শিক্ষা প্রদান করাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব। তবে শুধু শিক্ষক ও ছাত্রের উপস্থিতি শিক্ষাকে, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করেনা। শিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য থাকে, সংগঠন আর প্রশাসন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই শুধু ছাত্র–শিক্ষকের উপস্থিতি নয়। আছে এক প্রশাসন। সমাজ আছে, অথচ প্রশাসন নেই, এমনটা হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর শিক্ষার কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রয়েছে প্রশাসন। দেহের রক্ত পরিবহনতন্ত্রের যে কাজ, প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনেরও একই কাজ। দেহের রক্ত–দূষণ হলে, দেহ যেমন সুস্থ থাকেনা ঠিক তেমনি যেকোন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন অকার্যকর হলে, প্রতিষ্ঠানের সমস্ত অংশের মুখ থুবরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। এই কর্তৃত্ব পরিচালিত হয় সরকারের মাধ্যমে। সরকারের রয়েছে প্রশাসনিক বিভক্তি। রয়েছে প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগ। তিনটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যক্রমের বিভক্তি সুশাসনকে নির্দেশ করে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোটাদাগে বিশ্ববিদ্যালয়েরও রয়েছে প্রশাসনের বিভক্তি। সাধারণ বা জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ফিনান্সিয়াল বা আর্থিক প্রশাসন ও একাডেমিক প্রশাসন। এই তিন বিভক্তির রয়েছে পৃথক কার্যক্রম। প্রশাসনের কার্যক্রমের বিভক্তি প্রতিষ্ঠানের সুস্বাস্থ্য নির্দেশ করে। সরকারে বিভাগগুলো যেমন দেশের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধান দ্বারা বর্ণিত,ঠিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আইন, রুলস ও রেগুলেশনস দ্বারা আচরিত। সমাজে মানুষের আচরণকে নিয়মের অধীন ও তাঁদের আচরণকে সংঘবদ্ধ করবার জন্য রয়েছে, নর্ম, মূল্যবোধ, নীতি–নৈতিকতা, বিশ্বাস ইত্যাদি। আর এগুলো কার্যকর থাকলেই সমাজ হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ। ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়েরও রয়েছে নির্দিষ্ট আইন যার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয়, রয়েছে অফিসিয়াল কাঠামোগত অস্তিত্ব (একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট, ট্রাস্টি বোর্ড ইত্যাদি) এবং সময়ে সময়ে এদের প্রণীত স্টাটিউটস, অর্ডিন্যান্স, রূলস ও রেগুলেসন্স। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কাজের প্রত্যেক অংশের কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়।
পাবলিক বা প্রাইভেট, দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছে কর্তৃত্ব। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অর্থ কমিটি, বিভাগ ইত্যাদি। এসব কর্তৃত্বের প্রণীত নিয়মাবলির আলোকে পরিচালিত হতে হয় প্রতিষ্ঠানের জনবলকে। আর এমনটি যদি হয়, তো প্রতিষ্ঠান হবে শৃঙ্খলাবদ্ধ।
দীর্ঘকাল শিক্ষকতা ও দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একটা বিষয়ে প্রতীতি জন্মেছে, দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করলেও, আইন–কানুন, স্টাটিটিউটস, অর্ডিন্যান্স, রুলস্ মেনে চলার ক্ষেত্রে অনেকেই একেবারেই অজ্ঞ বা ইচ্ছে করেই নিয়ম ভায়োলেশনের এমন আচরণ করে থাকেন। অনেক সময়ে বিরাগের বা পক্ষপাতিত্বের বশবর্তী হয়ে অনেকেই এমনটি করেন। প্রশাসনিক যোগ্যতার অভাবও এমন আচরণের কারণ হতে পারে। সিভিল সার্ভিসের জনবলের প্রশাসন পরিচালনার শিক্ষণ আছে যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন শিক্ষণের বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছে যা বাস্তব সম্মত।
প্রশাসনের পদসোপানের দায়িত্বটাও বুঝতে হবে। উপাচার্য, ট্রাস্টি বোর্ডের আনুকূল্যে সামাজিক সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তবে সমস্ত সিদ্ধান্ত বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ এর অনুমোদনে হতে হবে। সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে তিনি প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করবেন। মনে রাখা ভালো যে, উপাচার্য বা অন্যরা সবাই আইন ও নিয়মের অধীন। পার্লামেন্টের আইন প্রণেতা, আইন প্রণয়নের পরে যেমন তিনিও সে আইনের অধীন, প্রণীত আইনকে তিনি ভায়োলেট করতে পারেন না, ঠিক তেমনি সব প্রশাসকের ক্ষেত্রেই এমনটি প্রযোজ্য। আমাদের অনেকেই পদকেই চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার উৎস মনে করেন; যদিও উৎস হচ্ছে – আইন। কোন সংগঠনে সমস্যার মূল কারণ, কারো কারো আচরণ যা নিয়মের ও রুলস্, রেগুলেশনের বিচ্যুতি। সামাজিক সমস্যা যেমন আইন–কানুন না মানার বিচ্যুতি থেকে আসে, ঠিক তেমনি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানেরও।
“Survival of the Fittest” বা “যোগ্যতমই বেঁচে থাকে“, বিষয়টি, প্রাণী জগতে প্রয়োগযোগ্য হলেও, সামাজিক জগতে, এর প্রয়োগ ভিন্ন আঙ্গিকেও হয়ে থাকে।অনেক সময়ে, সামাজিক ব্যবস্থার অস্বীকার, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষকে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দেয়। ফলে সামাজিক জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বিষয়টি একটু ভিন্ন। সামাজিক জীবনে মানুষের আচরণের বিচ্যুতি তাই, বেশ লক্ষণীয়। ব্যক্তি জীবনের বিচ্যুতি সামাজিক ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে আলোড়িত করে। এজন্য প্রতিষ্ঠানের সাফল্য সততা ও নিষ্ঠা ছাড়া কখনোই সম্ভব হয় না।
প্রতি মানুষেরই একাধিক পরিচিতি থাকে। যেমন কোন ব্যক্তি কারো পিতা, কারো সন্তান, কারো ভাই ইত্যাদি। এই পরিচিতি গুলো বায়োলজিক্যাল। আবার সামাজিক পরিচিতির দিক থেকে কেউ শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ইত্যাদি। তবে সমাজে বাস না করলে বা সামাজিক সম্পর্কে না থাকলে কেউই উল্লিখিত পরিচয় পেতে পারেন না। এইসব পরিচিতি সমাজ দেয়। যেমন সমাজ না থাকলে পরিবার থাকতোনা, আর পরিবার না থাকলে পিতা বলে কোন পরিচয়ই থাকতোনা। সামাজিক সম্পর্কে আছেন বলেই পিতা পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজ কোন ব্যক্তিকে পিতা পরিচয় দেয়ার সাথে সাথে তাঁর রোল বা কর্তব্যও জানিয়ে দেয়। যেমন পিতা হলে সন্তানদের প্রতি কর্তব্য পালনের কথা জানিয়ে দেয়। কেউ ডাক্তার হলে, সামাজিক সম্পর্কের ভেতরে অবস্থানের কারণেই তিনি এই পরিচিতি পান।তাঁর দায়িত্ব সমাজের মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা। আমরা ধারণা করতে পারি, পরিচিতির সাথে সাথে দায়িত্ব ও বর্তায় মানুষের উপর। সমাজের সার্থক মানুষেরা, সমাজ বর্ণিত দায়িত্ব পালনের জন্যই মহৎ হয়ে উঠেন। একটি সমাজ অথবা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের গতি পায়, এই ধারায়। একটি প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মজীবীদের যে পরিচিতিই সংগঠন দিকনা কেন, তাঁকে মনে রাখতে হবে, সংগঠনের কর্ম সম্পর্কের কারণেই, তাঁর এই পরিচিতি। অন্যদের অনুপস্থিতি, তাঁর এই পরিচিতি প্রাপ্তিতে সহায়ক হতোনা। সংগঠন ও অন্যদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব সম্পাদন তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য। কর্তব্য পালনে প্রতিজনের এখতিয়ারের সীমারেখা আছে। এই সীমার ভেতরে থাকাটাই সংগঠনের স্থিতির জন্য প্রয়োজন। এই সীমারেখা প্রতি প্রতিষ্ঠানের আইন, রুলস বা রেগুলেশনে বর্ণিত আছে। মানুষে–মানুষে সম্পর্কই শুধুমাত্র সমাজ নির্মাণ করেনা। মানুষে–মানুষে আচরণের সম্পর্ক নির্ধারণে প্রয়োজন নর্ম, মূল্যবোধ, আইন–কানুন, রীতি–নীতি ইত্যাদি এবং যখন এইগুলো মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং সেই অনুযায়ী মানুষের আচরণ নির্ধারিত হয়, তখনই সমাজ হয়। সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানেও তাই। প্রতি সংগঠনে বা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধি আছে। আছে দায়িত্ব পালনের নীতিমালা। এগুলো মেনে চলা প্রতিষ্ঠানের সংহতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এর জন্য প্রয়োজন। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী,ক্ষণস্থায়ী কর্মজীবনও । ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষ, উত্তরাধিকারীদের জন্য একটা সুন্দর জীবন নির্মাণ করার চেষ্টা করেন, কেন নয়, প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত নির্মাণের চেষ্টায়?
লেখক : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড
টেকনোলজি, চট্টগ্রাম