প্রতিশোধ নয় ক্ষমাই ইসলামের সৌন্দর্য

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করতে পারা অনেক বড় মানবিক গুণ। জীবনে চলার পথের অনেকের আচরণ বা উচ্চারণে আঘাত আসতে পারে। প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমার শক্তি অর্জন করা চাই। এতে পরকালে যেমন মিলবে বিশাল প্রতিদান দুনিয়াতেও আসবে শান্তি, স্থিতি ও সম্মান।
প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। মানুষের আত্মার প্রশান্তি কেড়ে নেয়। এর প্রভাবে মানুষ বহু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সমাজে ঘটে যাওয়া বেশির বিশৃঙ্খলা ও হত্যাগুলো প্রতিশোধপরায়ণতা থেকেই হয়। অনেক সময় প্রতিশোধ নিয়ে গিয়ে মানুষ তার প্রতিপক্ষের নিষ্পাপ আত্মীয়-স্বজনের ওপর আক্রমণ করে বসে।
প্রতিশোধ মানে কোনো অন্যায় কাজ হয়ে থাকলে সেই কাজটি নিজে করে প্রশান্তি অর্জন করা। তাই কেউ কোনো ক্ষতি করলে আমরা তার প্রতিশোধ নিতে উঠে পড়ে লাগি। সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। অনেকে অন্তরে রাগ পুষে রাখি।
ক্ষমা করা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন মুত্তাকি তারাই যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা রাগ সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল হয়। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। (সুরা আলে ইমরান : ১৩৪)
ক্ষমা মহত্ব্‌ের লক্ষণ। যারা যত বেশি মহৎ তারা তত বেশি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করলে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে-ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম : ২৫৮৮)
জীবনের এক কঠিনতম সময়ে আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) তায়েফে গিয়েছিলেন আশা করেছিলেন তায়েফবাসী তাঁর কথা শুনবে তাঁকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সহযোগিতার পরিবর্তে তিনি পেলেন অপমান। তাঁর শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পায়ে গিয়ে জমাট বাঁধল। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে একজন ফেরেশতা এলেন। ফেরেশতা তায়েফের দুপাশের পাহাড় এক করে দিয়ে তায়েফবাসীকে হত্যা করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু দয়াল নবী (সা.)-এর উত্তর ছিল (না তা হতে পারে না) বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশে এমন সন্তান দেবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না। এ ক্ষেত্রে হজরত আলী রা:-এর প্রসিদ্ধ ঘটনাটি থেকেও আমরা উপকৃত হতে পারি। হজরত আলী রা: জনৈক শক্তিমান শত্রুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন। বহুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর তাকে কাবু করে ভূপাতিত করলেন এবং তাকে আঘাত করার জন্য তার জুলফিকার উত্তোলন করলেন। কিন্তু আঘাত করার আগেই ভূপাতিত শত্রুটি হজরত আলী রা:-এর চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করল।
ক্রোধে হজরত আলী রা:-এর চেহারা রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। মনে হলো এই বুঝি তাঁর তরবারি শতগুণ বেশি শক্তি নিয়ে শত্রুকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলবে। কিন্তু তা হলো না। যে তরবারি আঘাত করার জন্য ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হয়েছিল এবং যা বিদ্যুৎ গতিতে শত্রুর দেহ লক্ষ্যে ছুটে যাচ্ছিল তা থেমে গেল। শুধু থেমে গেল না ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। পানি যেমন আগুনকে শীতল করে দেয় তেমনিভাবে আলী রা:-এর ক্রোধে লাল হয়ে যাওয়া চেহারা শান্ত হয়ে পড়ল। হজরত আলী রা:-এর এই আচরণে শত্রুটি বিস্ময়-বিমূঢ়। যে তরবারি এসে তার দেহকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলার কথা তা আবার কোষবদ্ধ হলো কোন কারণে? বিস্ময়ের ঘোরে শত্রুর মুখ থেকে কিছুক্ষণ কথা সরল না। এমন ঘটনা সে দেখেনি শোনেওনি কোনো দিন। ধীরে ধীরে শত্রুটি মুখ খুলল। বলল আমার মতো মহাশত্রুকে তরবারির নিচে পেয়েও তরবারি কোষবদ্ধ কেন করলেন?
হজরত আলী রা: বললেন আমরা নিজের জন্য কিংবা নিজের কোনো খেয়ালখুশি চরিতার্থের জন্য যুদ্ধ করি না। আমরা আল্লাহর পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যুদ্ধ করি। কিন্তু আপনি যখন আমার মুখে থুথু নিক্ষেপ করলেন। তখন প্রতিশোধ গ্রহণের ক্রোধ আমার কাছে বড় হয়ে উঠল। এ অবস্থায় আপনাকে হত্যা করলে সেটি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হতো না। বরং তা আমার প্রতিশোধ গ্রহণ হতো। আমি আমার জন্য হত্যা করতে চাইনি বলেই উত্তোলিত তরবারি ফিরিয়ে নিয়েছি। ব্যক্তিস্বার্থ এসে আমাকে জিহাদের পুণ্য থেকে বঞ্চিত করুক তা আমি চাইনি। শত্রুটি ভূমি শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাথে সাথে তাওবা করে ইসলাম কবুল করল। এমন অদম্য অতুল্য বীরের ক্ষুব্ধ হৃদয়েও এত বেশি ক্ষমা ও স্বস্তিগুণ বিদ্যমান থাকে এত বড় যোদ্ধা চরম মুহূর্তেও এমন ভীষণ শত্রুকে এতটুকু কর্তব্যবোধে ছেড়ে দিতে পারেন! এ ছাড়াও মক্কা বিজয়ের পরের ইতিহাসই দেখুন রাসূল সা: তখন কি কোরাইশদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছেন? অথচ এই কোরাইশরা রাসূল সা:-এর সাথে ইসলামের সাথে কী করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মক্কা বিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পরও যে সাত ব্যক্তি সম্পর্কে হত্যার রায় দিয়েছিলেন যে তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। এমনকি যদি কাবার গিলাফ ধরা অবস্থায়ও পাওয়া যায়। তবুও তাদের হত্যা করা হবে। এমন দাগী আসামির বেশির ভাগই ক্ষমা পেয়ে যান প্রিয় নবীর কাছে। এতেই বোঝা যায় তিনি কতটা দয়াশীল ছিলেন !
প্রতিশোধ নিলে আমাদের শত্রুতা কমবে না বরং বাড়তেই থাকবে। আর মন্দের বিপরীতে উত্তম করলে ক্ষতির বিপরীতে উপকার করলে সে আমাদের শত্রু হবে না শত্রুতাও বড়বে না। বরং শত্রু আমাদের অনুগত হবে আমাদের সামনে মাথানত করবে তার মধ্যে অনুতাপবোধ জাগ্রত হবে যে আমি তাদের ক্ষতি করলাম তাদের কষ্ট দিলাম আর তারা আমার উপকার করলেন। আমি কতটা নিম্নমানের লোক ইত্যাদি। তাই আমরা প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করতে শিখি। অথবা প্রতিশোধটা অন্যভাবেও নিতে পারি। আপাতত চেষ্টাটা তো করে দেখতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের মহৎ এই গুণ অর্জন করে মানুষের মন জয়ের পাশাপাশি আল্লাহর মনোনীত বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ সবাইকে ক্ষমাশীলতা অর্জনের তাওফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভোরের পাখি দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা