ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক এহছানুল হক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে কোন হুমকি না থাকলেও এর গুরুত্ব আসলে কৌশলগত। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমা নির্ধারণের পরে বাংলাদেশ একটি বিশাল সমুদ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের দায়িত্বও বেড়ে গেছে অনেক’। নৌবাহিনীর রিয়ার এডমিরাল আওয়ালের মতানুসারে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য চলে সমুদ্র পথে। আর সেই সাথে সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে বাংলাদেশে যে পরিকল্পনা সেই কার্যক্রমের নিরাপত্তা দেওয়াও এ ঘাঁটি স্থাপনের একটি উদ্দেশ্য বলে তিনি মনে করেন। বানৌজা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাব মেরিন ঘাঁটি যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’। এ নৌঘাঁটির জন্য কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা মোতাবেক ৩৩৩.৭৩ একর জমি অধিগ্রহণ এর মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। (তথ্য: বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন)
সাব মেরিন বা ডুবোজাহাজ হচ্ছে পানির নিচে চলাচলে সক্ষম ও স্বাধীনভাবে বিচরণকারী নৌযান বিশেষ। জাহাজের মতোই সাবমেরিনে অনেক ক্রু থাকে। অনেক আগেই থেকেই পরীক্ষা মূলকভাবেই ডুবো জাহাজ বা সাবমেরিন নির্মাণ করা হয়। ১৯ শতকে এসে সাবমেরিন আধুনিক রূপ পায়। ১৬২০ সালে কর্ণেলিয়াস জ্যাকবস জুন ড্রেবল নামীয় একজন ডাচ কর্তৃক নৌযান বাহন হিসেবে সাবমেরিন আবিষ্কার করা হয় বলে জানা যায়। তিনি ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের অধীনে রাজকীয় নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। উইকিপিডিয়া অনুযায়ী পৃথিবীর স্বাধীন-স্বার্বভৌম ১৯৫টি দেশের মধ্যে বানৌজা শেখ হাসিনা ৪১তম মেরিন ঘাঁটি।
১২ই মার্চ ২০২০ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার মগনামায় এই মেরিন ঘাঁটিটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। দুটি সাবমেরিন কমিশনের মাধ্যমে বিশ্বের ৪১তম সাবমেরিন পরিচালনাকারী দেশের তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। চীন থেকে ক্রয়কৃত সাবমেরিন দুটির নাম ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’। নতুন সাবমেরিন কমিশনিং ও সাবমেরিন ঘাঁটি স্থাপনের ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক শক্তির অধিকারী হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সমুদ্র সীমা জয়ের মাধ্যমে আরো বিস্তৃত বাংলাদেশের বিশাল জলসীমার সার্বভৌমত্ব রাখার পাশাপাশি তেল, গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলোর নিরাপত্তাসহ দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে এই সাবমেরিন ঘাঁটি বিশাল ভূমিকা রাখবে। জাতির পিতার কন্যা পিতার মতন স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে জানেন যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পদ্মা সেতু। তাইতো ২০১৪ সালে চীনের সাথে প্রায় ১৫৬৯ কোটি টাকায় দুটি সাবমেরিন ক্রয় করার জন্য বাংলাদেশ চুক্তিবদ্ধ হয়। টর্পেডো ও মাইনে সুসজ্জিত সাবমেরিন দুটির দৈর্ঘ্য ৭৬মিটার, প্রস্থ ৭.৫ মিটার। ঘন্টায় ১৭ নটিক্যাল মাইল গতিতে এই সাবমেরিন বর্হি শক্রর যুদ্ধ জাহাজ ও ডুবো জাহাজে আক্রমন চালাতে সক্ষম। প্রতিটি সাবমেরিনে থাকতে পারবেন ৫৭ জন কর্মকর্তা ও ক্রু।
সাবমেরিনকে ংঃৎধঃবমরপ বিধঢ়ড়হ বলা হয়ে থাকে। সাবমেরিন দিয়ে যে শুধুই যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করা হয় এটি মনে করার কোন কারণ নাই। যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শত্রুপক্ষের সাপ্লাই চেইন ধ্বংস করা। সাপ্লাই চেইন ধ্বংস হলে শক্র পক্ষ বিপর্যস্ত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাবমেরিন দিয়ে আমরা গভীর সমুদ্রে মিয়ানমারের সমুদ্রগামী অনায্য বাণিজ্যিক জাহাজের উপর অবরোধ আরোপ করতে সক্ষম হবো। মিয়ানমারের জাহাজে ংবধ বংঃধঃব কম থাকার কারণে তাদের নৌবাহিনীতে যত জাহাজ আছে বেশিরভাগ জাহাজই গভীর সমুদ্রে মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম নয়। বাংলাদেশে তুলনামূলক কম ওজনের জাহাজের ডিজাইন এমনভাবে করা সেটি ংবধ বংঃধঃব ৪ এর অধিক পরিবেশে অনায়াসে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে শক্র দেশের নৌপথ বন্ধ করার বড় অস্ত্র সাবমেরিন। যুদ্ধের একটি বড় কাজ হচ্ছে শক্র পক্ষকে ভীত করা। এক স্কোয়াড্রন মাল্টিরোল বিমান যতটুক ভয় সঞ্চার করতে পারে তারচেয়ে সাবমেরিন অনেক বেশি হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম। সামরিক বিশ্লেষকরা এই বিষয়ে জানেন। সমুদ্র বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। সমুদ্র নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজন নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি। এই সাবমেরিন স্থাপনের ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে। (সূত্র: ডিফেন্স রিসার্চ ফোরাম) ২০১৪সালে চুক্তিকরা সাবমেরিন দুটি ২০১৬ সালের ১৪ই নভেম্বর চীনের দালিয়ান প্রদেশে লিয়াওয়ান শিপ ইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সি ট্রায়ালের পর চীন ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নাবিকদের তত্ত্বাবধানে একই বছরের ২২ডিসেম্বর সাবমেরিন দুইটি বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।
এই সাবমেরিন ঘাঁটির প্রকল্প ব্যয় ১০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আধুনিক বাহিনৗতে রূপান্তর ও ক্ষমতা বাড়াতে ১০ বছরব্যাপী পরিকল্পনার একটি অংশ এই সাবমেরিন ঘাঁটি। এই ঘাঁটির নির্মাণে কর্মরত প্রকৌশলী জিসাদের সাথে আলাপে জানা যায় এই ঘাঁটিতে প্রায় ১৫০০ জন শ্রমিক কর্মচারী কাজ করেন। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া নির্মাণাধীন এই ঘাঁটিটি এ ঃড় এ চৎড়লবপঃ এর মাধ্যমে ৫ বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এই নৌঘাঁটি নির্মাণের ফলে কুতুবদিয়া দ্বীপে বিদ্যুতায়ন হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার এলাকার অর্থনৈতিক পণ্য লবণ, চিংড়ি সমুদ্রের তলদেশের মাধ্যমে পরিবহনও করা যাবে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে। পেকুয়ার একতা বাজার হতে বানৌজা শেখ হাসিনা বেইজ রোড পর্যন্ত ৪ লাইনের রাস্তার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। রোডস এন্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে রোড ডিভিশন কক্সবাজার রাস্তাটির তত্ত্বাবধান করছে। প্রকল্পটির নাম ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ ড়ভ ঊশড়ঃধ ইধুধৎ ঃড় ইঘঝ ঝযবরশয ঐধংরহধ ইধংব জড়ধফ (ত-১১২৫) রহ ঈড়ী্থং ইধুধৎ উরংঃৎরপঃ. প্রকল্পটির সময়কাল ১৮ মাস।
বানৌজা শেখ হাসিনা মেরিন ঘাঁটি সংযোজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছে। নবদিগন্ত সূচিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়। জাতির পিতার স্বপ্ন সাধের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাঁরই যোগ্য উত্তরাধিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে। স্বপ্ন দেখছে ২০৪১ সালে স্বনির্ভর আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক