চলমান উন্নয়ন ডিসকোর্সে জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাময় অনুঘটক হিসেবে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। এটিকে যে কোনো দেশের কর্মসংস্থান, নতুন প্রযুক্তি হস্তান্তর, অভিনবমূলক ব্যবস্থাপনা কৌশল শেখা ও ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতা বৃদ্ধি, নতুন বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত এবং অভ্যন্তরীণ বাজার কার্যকারিতা বৃদ্ধির অন্যতম বড় উৎস বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য। স্বভাবত এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ থেকে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এফডিআইসহ দেশে অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে গত দুই দশকে জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নে লক্ষ্যণীয় সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। নীতি কাঠামোয় এনেছে পরিবর্তন। বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিনিয়োগের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এত সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অনেক দিন ধরে ব্যক্তি বিনিয়োগ জিডিপির ২২-২৪শতাংশের মধ্যে স্থবির হয়ে আছে। বিদেশী বিনিয়োগও আশানুরূপ নয়। এর মধ্যে খবর মিলছে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে চলতি বছর জানুয়ারি-জুন সময় পর্বে গ্রিনফিল্ড এফডি-আই বা নতুন প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ কমেছে ৮৪ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এ ধরনের বিনিয়োগ আপাতত কমাটা অননুমেয় নয়। কিন্তু বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে অন্যতম সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপনের রাষ্ট্রীয় আয়োজন ও তৎপরতা সত্ত্বেও কোভিড-পূর্ব সময়েও কেন প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ খুব একটা বাড়েনি, তার কারণ পর্যালোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। নইলে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে আমরা পিছিয়ে পড়ব।
শিক্ষাগত রূপান্তর ও দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে শ্রমশক্তির বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগী সক্ষম দক্ষতা ভিত্তি বাড়াতে হবে। এছাড়া সংঘাতমূলক ট্রেড ইউনিয়ন, রাজনৈতিক সংঘাত এবং ভালো নীতিগুলোর ধীর বাস্তবায়নের মতো কিছু সমস্যা আছে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এসব সমস্যাও সমাধান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় নতুন প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। ইন্দোনেশিয়ার বাড়ার কারণ দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সংহতকরণের পাশাপাশি বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করেছে। ফলে সেখানে বিনিয়োগ ঝুঁকি অনেকাংশে কমেছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাড়ছে বিদেশী বিনিয়োগ। অন্যদিকে কম্বোডিয়ায়ও সমরূপ অবস্থা।
দেশটিতে একটি উন্মু্ক্ত ও উদার বিদেশী বিনিয়োগ রেজিম বিদ্যমান। তদুপরি সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিসহ কোম্পানিতে ১০০ শতাংশ বিদেশী মালিকানা নিশ্চিত এবং কেবল ২০ শতাংশ করপোরেট করের মতো কিছু প্রণোদনা রয়েছে সেখানে। সব মিলিয়ে সেখানেও বেড়েছে গ্রিনফিল্ড এফডিআই। সুতরাং বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়াতে আমাদের দেশেও প্রতিযোগিতা দেশগুলোর নীতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ইতিবাচক বিষয় হলো বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। এক. কর অব্যাহতি। বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুযোগ দিচ্ছে। দুই. আমদানি শুল্ক ছাড়, রফতানিমুখী শিল্পের জন্য কোনো আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য নয়। সুনির্দিষ্ট প্লান্ট, যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও আমদানি শুল্কের অব্যাহতি রয়েছে। তিন.মূলধন প্রত্যাবাসন। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কর প্রদানের মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগকৃত মূলধন মুনাফা ও লভ্যাংশ পুরোপুরিভাবে প্রত্যাবাসন করতে পারেন এখন। চার. প্রস্থান। যে কোনো সময় বিদেশী যেকোনো নাগরিক চাইলে আইনগত বিধি মেনে তার বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। আগে এ সুযোগ না থাকলেও এখন এ ধরনের নীতি নেয়া হয়েছে। পাঁচ. শেয়ার বাজার বিনিয়োগ। বিধিমূলক নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে অংশ নেয়ার সুযোগ আছে। একইভাবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত শেয়ার থেকে ক্যাপিটাল গেইনে কর অব্যাহতির পাশাপাশি কোম্পানির ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও নিম্ন সুদহার বিদ্যমান। শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, এগুলো কীভাবে বিদেশীদের অবগত করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।