প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই বিশ্বে প্রতিনিয়ত প্রত্যেক কর্ম প্রার্থীকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিযোগিতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে গেলে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার কোনো বিকল্প নেই। সময়ের সাথে তাল মিলাতে হলে একজন ছাত্রকে, ব্যবসায়ীকে একজন পেশাজীবীকে বা সর্বস্তরের কর্মজীবীকে অবিরাম যোগ্যতা, দক্ষতা ও কর্মতৎপরতা বাড়াতে হবে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে, বিজ্ঞান–প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে। পেশাগত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তারও পরিবর্তন হচ্ছে। ছাত্র এবং অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলা যায় একজন ছাত্র পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় নেমে শিক্ষক, পরিবার শুদ্ধ সেই ছাত্রের পেছনে খেটে এবং ছাত্রের নিরলস পরিশ্রমে তাকে জিপিএ ৫ বা গোল্ডেন জি.পি.এ পেতে হবে এমন নয়। তাই জিপিএ–৫ অপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে বলা যায় জিপিএ–৫ না পেয়েও কিন্তু জীবনে উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠা যায়। তবে সাধনা ও লেগে থাকতে হবে। তাই অভিভাবক ও ছাত্রদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশে বিদেশে এর অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন বিশ্বের অন্যতম ধনী যার নাম অনেকেই জানেন– ‘বিলগেটস’। তিনি বলেছেন ‘আমি কোনোদিন পরীক্ষায় প্রথম হইনি। কিন্তু বিশ্বের সেরা ইউনিভার্সিটিতে যারা প্রথম হয়েছিল তারা এখন অনেকেই আমার কর্মচারী। সুতরাং ১ম বা জিপিএ–৫ না পেয়েও জীবনে অনেক বড় কিছু করা যায়। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ‘আইনস্টাইন’, টিউটন আরও অনেকে তারাও ক্লাসে প্রথম হয়নি। আমাদের দেশের কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায়– বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ‘সাকিব আল হাসান’ সে ও তো জিপিএ–৫ পায়নি। জনপ্রিয় গায়িকা ‘মমতাজ বেগম’ যার প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিতি লক্ষ টাকা। সেও তো জিপিএ–৫ পায়নি বা পেইন্টার ‘জয়নাল আবেদিন’ যার প্রতিটা পেইন্টের মূল্য কয়েক লক্ষ টাকা, সে ও তো জিপিএ–৫ পায়নি। বিভিন্ন পেশায় গিয়েও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা যায়। বিজ্ঞানী, ডক্টরেট, এমিরেটস, চৌকশ লোক আছেন তারা জিপিএ–৫ পায়নি। আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এম.এ. হামিদ কথায় কথায় বলে থাকেন ‘আমি ক্লাসের পিছনের বেঞ্চের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু আজ বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। মনে করোনা যে তুমিও একদিন রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না। সুতরাং সম্মুখ দিকে এগিয়ে যাও, থামবে না। হেরে গিয়ে যেন থেমে না যাও।’ নিজের উপর বিশ্বাস রাখলে আলো আসবেই। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে পেছনের বেঞ্চের ছাত্র–ছাত্রীরা জীবনে উন্নতি করেছে বেশি।
একজন অযোগ্য ব্যক্তি যত পরিকল্পনাই করুন না কেন, যত সুযোগ সন্ধানীই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত তিনি অযোগ্য ও অদক্ষ থাকেন। তার ছাপ তার কর্মফলে পড়বেই। যেমন বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে। সুতরাং নিজেকে প্রকৃত দক্ষ করে তুলতে হবে। ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। এর মূল্যায়ন একদিন হবেই। সূর্য উঠলে যেমন সব অন্ধকার দূরীভূত হয়ে জগত আলোকিত হয়ে উঠে। দক্ষতাও তেমনি আলোর মত ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের সামনে যতই কাল মেঘ আসুক, তাহা কিছুক্ষণের মধ্যে সরে গিয়ে সূর্য আবার চারিদিকে আলোকিত করে। মানুষের জীবনে জীবনকে অপরিহার্য করে তুলতে হয়। কারণ আমরা কোনো না কোনোভাবে একে অপরের অপরিহার্য। এটিই বাস্তবতা। নিজেকে অপরিহার্য করে গড়ে তুলতে হবে। এই সন্বন্ধে ‘মার্টিন লুথার কিং’ যিনি আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামী নেতা ছিলেন। তিনি নিজের প্রাণ দিয়ে বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আমরা প্রত্যেকে এক অপরিহার্য সমঝোতার জালে জড়িয়ে আছি– যাহার প্রতিটি সুতা একটি আরেকটির সাথে জড়িয়ে আছে।’ তিনি বলেন মাঝে মাঝে সেই সুতা ছিড়ে যায়। তখন অপরিহার্যতা থাকে না। এও দেখা যায় কিছু লোক নিজেকে জোর করে অপরিহার্য বলে মনে করে। কিন্তু বিচক্ষণেরা তা করে না। অপ্রয়োজনে কেউ কারো ভার বহন করে না এবং না করা উচিৎ। যেমন শীতকালে গাছ তার শুকনো পাতাগুলোকে ছেড়ে দেয় যাতে ঐ পাতাগুলি তার রস শুষে না ফেলে। কিন্তু আরব্য রজনী গল্পের ‘সিন্দবাদ’ তা করেছিল। ‘সিন্দবাদ’ তার সমুদ্র যাত্রায় যখন জাহাজ ডুবে গেল– সে একা হয়ে যায় এবং একটা দ্বীপে আশ্রয় নেয়। সেখানে তিনি এক জলপ্রপাতের সাঁকোর কাছে উলঙ্গ একজন মানুষকে দেখতে পায়। তিনি চিন্তা করলেন তার মতো ঐ লোকটি জাহাজ ডুবির পর সর্বস্ব হারিয়ে এই দ্বীপে আটকা পড়েছেন। লোকটির কাছে গেলেই লোকটি বললেন, তিনি নিরুপায়, চলার শক্তি নেই এবং খুব তৃষ্ণার্ত। সিন্দবাদ সমব্যথী হয়ে তাকে কাঁধে করে একটি ঝরনার ধারে নিয়ে গেলেন ও তেষ্টা মেটালেন। কিন্তু ঐ লোকটি সিন্দবাদের কাঁধ হতে কিছুতেই নামলেন না এবং লোহ শক্ত হাতে তাঁর কাঁধ এমনভাবে আঁকড়িয়ে ধরলেন সিন্দবাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। অত:পর অনেক চেষ্টা করে বিশেষ কৌশলে তাকে হত্যা করে সিন্দবাদ তার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। এই কথাটার অর্থ হলো অযোগ্য, অপ্রয়োজনীয় লোকের ভার সিন্দবাদের মতো কেউ নেবে না। এটিই জগতের বাস্তবতা। তাতে নিজের ক্ষতি, প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি। বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া সংকটগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেকারত্ব। তাতে আবার অশিক্ষিতের চেয়ে শিক্ষিতের সংখ্যা ভয়াবহ। জনসংখ্যার সাথে কর্মসংস্থানের সমন্বয় না থাকার কারণ। স্বাধীনতার ৫২ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লে ও তৈরী হয়নি অনুপাতে নতুন কর্মসংস্থান। এখানে আরও একটা জিনিষ উল্লেখ্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করেও চাকরি না পাওয়ার প্রধান কারণ নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব। কর্মসংস্থানের অভাব থাকার পরও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান চাহিদানুযায়ী কর্মী নিয়োগ দিতে পারছে না। কারণ চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় অদক্ষতার মধ্যে রয়েছে ভাষা দক্ষতা, প্রযুক্তি জ্ঞানসহ অন্যান্য দক্ষতার ঘাটতি। এই দক্ষতার ঘাটতি দেশকে শ্রমশক্তিতে পিছিয়ে দিচ্ছে। তাতে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এইখানে উল্লেখ্য বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ‘স্টিফেন হকিং’ বলেছেন দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করতে গেলে কৌতূহলী হও। টেকনিক্যাল শিক্ষাতে কৌতূহলী হতে হয় তবেই দক্ষতা বাড়ে। কারণ অদক্ষ শক্তি বেকারত্ব বাড়ায়। যেহেতু প্রযুক্তি শিক্ষার চাহিদা বহি:বিশ্বে খুব বেশি তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছেন এবং নানারকম প্রকল্প গ্রহণ করে যাতে বেশি দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন করা যায় তার বিশেষ ব্যবস্থা করছেন। তাতে বেকারত্ব যেমন কমবে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে।
লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিষ্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।