কক্সবাজারের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) দুই হাজার যাত্রী ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়ানোর জন্য জেটি বানাতে চায় চট্টগ্রাম কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লি.। তবে সৈকত এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকায় পরিবেশ দূষণের আশঙ্কায় কর্ণফুলী বিল্ডার্সের প্রস্তাবিত জেটি নির্মাণ প্রকল্পকে ‘না’ করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পাশাপাশি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, কঙবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়কে ভবিষ্যতে ইসিএ এলাকায় জেটি নির্মাণের যেকোনো ধরনের প্রস্তাবকে নিরুৎসাহিত করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কঙবাজার জেলার রামু উপজেলার জঙ্গল খুনিয়া পালং এলাকার সাগর সৈকতে জেটিটি নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার জঙ্গল খুনিয়া পালং এলাকার সাগর সৈকত এলাকায় জেটি নির্মাণের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্রের আবেদন করে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লি.। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থান পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রতিবেদন দেয়। পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের জেটি নির্মাণ স্থানটি কঙবাজারের কলাতলী ডলফিন চত্বর থেকে মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে আনুমানিক ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জেটি নির্মাণ স্থানের পূর্ব দিকে মেরিন ড্রাইভ রোড এবং তৎপরবর্তী পাহাড়। উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগর।
এদিকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ আইন ১৯৯৫ (সর্বশেষ সংশোধিত ২০১০) অনুসারে এই পর্যন্ত ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া- ইসিএ) ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধে কঙবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় জলাভূমিসহ উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। কঙবাজার জেলার রামু উপজেলার জঙ্গল খুনিয়া পালং মৌজায় প্রস্তাবিত জেটি নির্মাণ প্রকল্পের স্থানটিও ইসিএ এলাকার অন্তর্ভুক্ত বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ইসিএ এলাকায় প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কর্তন, আহরণ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থাল ধবংসকারী সকল প্রকার কার্যকলাপ, ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট কিংবা পরিবর্তন করতে পারে এমন সকল কাজ, মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো প্রকার কার্যাবলী নিষিদ্ধ।
এছাড়া গত ৬ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের গত ১৬ আগস্টের পরিপত্রে ‘নির্মাণাধীন কঙবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্পের সড়ক ও সাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না’ মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ২৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র বিষয়ক কমিটির ৪৬০তম সভায় কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সকে ছাড়পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরিবেশগত ছাড়পত্র বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক ও অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) সৈয়দ নজমুল আহসানের সভাপতিত্বে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, মেসার্স কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লি. জেটির আবেদনপত্রে এবং আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত শিল্প প্রকল্প ব্যতীত অন্য কোনো প্রকল্পের জন্য প্রযোজ্য নয় এমন পূরণকৃত আইইই চেকলিস্টের কোথাও প্রস্তাবিত মেসার্স কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লি. জেটির সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান উল্লেখ করা হয়নি। আবেদনপত্রে সংযুক্ত তথ্যাদিতে প্রস্তাবিত স্থানের দাগ নাম্বার, জমির চৌহদ্দী, কোনো কিছুই উল্লেখ নেই। আবেদনে উল্লেখ নেই জমির পরিমাণও। আবেদনে নতুন একটি দুই হাজার যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ প্রস্তাবিত এই জেটির মাধ্যমে কঙবাজার হতে সেন্টমার্টিন যাতায়াত করবে বলে উল্লেখ করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র বিষয়ক কমিটির পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়, দুই হাজার যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ চলাচলের জন্য জেটি নির্মিত হলে উক্ত এলাকায় প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটক এবং বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানকারী ব্যক্তির সমাবেশ ঘটবে। এর ফলে ওই এলাকায় ব্যাপক কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্যের নিঃসরণ ঘটবে, যার দ্বারা সৈকত এলাকা এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকায় পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া প্রস্তাবিত জেটি এলাকা থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত দীর্ঘ সমুদ্রপথে বিশাল আকৃতির জাহাজ চলাচলের ফলে পানিতে তেল নিঃসরণজনিত দূষণের আশঙ্কা রয়েছে। দূষণের কারণে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় অবস্থিত জেটি সংলগ্ন সৈকতের প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থলসহ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীববৈচিত্র্য, জেটি এলাকা থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্রপথের পাশের সম্পূর্ণ সৈকত এলাকার প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থলসহ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীববৈচিত্র্য এবং দীর্ঘ যাত্রাপথের মৎস্য সম্পদসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা দৈনিক ১২৫০-এ নামিয়ে আনার জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এক্ষেত্রে নতুনভাবে ২০০০ যাত্রী সংখ্যা ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ কঙবাজার বিচ হতে পরিচালনা করার অনুমোদন প্রদান কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। ইতোমধ্যে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে কয়েকটি পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করে। এছাড়া মেসার্স কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের অন্য একটি পর্যটকবাহী জাহাজ কঙবাজার শহরের বিআইডব্লিউটিএ জেটি থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে চলাচল করে। এই অবস্থায়, প্রস্তাবিত জাহাজ চলাচলের ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও দ্বীপসংলগ্ন কোরাল কলোনির তথা কঙবাজার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার জীববৈচিত্র্যের ওপর আরো বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা আজাদীকে জানান, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সকে কঙবাজারের রামুতে জেটি নির্মাণের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কারণ ওই এলাকাটি সরকারের ইসিএ ঘোষিত এলাকা। গত সপ্তাহে চিঠি দিয়ে বিষয়টি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও একটি চিঠি দেওয়া হতে পারে প্রতিষ্ঠানটিকে।