সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী বা অনগ্রসর জাতি- তারা যেন যথাযথভাবে চাকরি পায় এবং চাকরিতে তাদের অধিকার নিশ্চিত হয় নীতিমালায় সেই ব্যবস্থাটা অবশ্যই করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ প্রাপ্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরাও যে দেশের সমৃদ্ধিতে শামিল হতে পারে, বিশ্বজুড়ে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা সমাজ ও উন্নয়নের প্রতিবন্ধক নয়, বরং অংশীজন। আমাদের দেশের সরকারও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সংকল্পবদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে এ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন পাস হয়। প্রতিবন্ধকতা জয় করে যারা সফল হওয়ার লক্ষ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। সমপ্রতি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার নীতিমালা জারি করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য-উপাত্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী কর্মকর্তা মো. আরাফাত রহমান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, সব প্রতিবন্ধিতা দৃশ্যমান নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা দীর্ঘস্থায়ীও নয়। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রতিবন্ধিতা দেখা যায়। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে মর্মে ধারণা করা হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বেশিরভাগই দারিদ্র্যের শিকার তথা নিম্ন আয়ভুক্ত বলে বিভিন্ন গবেষণায় লক্ষ করা যায়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসন ও জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। দারিদ্র্য নিরসন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তাদের উপযোগী চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পিত কার্যক্রম। এই লক্ষ্যে প্রতিবন্ধিতার ধরন চিহ্নিতকরণ, মাত্রা নিরূপণ ও কারণ নির্দিষ্টপূর্বক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয়ের নিমিত্ত দেশব্যাপী প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
বেশির ভাগ প্রতিবন্ধকতার কারণ জানা যায় না। কিন্তু যেগুলো সম্বন্ধে জানা যায়, তা কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যা নিচে উল্লেখ করা হলো:সাধারণ কারণ সমূহ: ক) বংশানুক্রমিক খ) রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন কোন আত্মীয়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গ) দুর্ঘটনা ঘ) উচ্চ মাত্রার জ্বর ঙ) বিষক্রিয়া চ) মস্তিষ্কের কিছু কিছু ইনফেকশন বা অসুখ বা টিউমার ছ) পুষ্টি, ভিটামিন, আয়োডিন ইত্যাদির অভাব। জন্ম-সম্পর্কিত কারণ সমূহ: জন্মের পূর্বে: ক) মায়ের বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে অথবা ৩০ বছরের উপরে হয় খ) গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির অভাব গ) গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে যদি মা কোনরকম কড়া ওষুধ গ্রহণ করে থাকে অথবা কীটনাশক, রাসায়নিক, রশ্মি, বিষক্রিয়া গ্রহণ করে থাকে। ঘ) গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের বিশেষ হাম হয়। এটি সাধারণত প্রভাব বিস্তার করে থাকে ইন্দ্রিয়স্থান (শ্রবণ এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের ক্ষেত্রে), মস্তিষ্কের সেরেব্রাল পালসি অথবা মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব অথবা শরীরের অভ্যন্তরের বাহুতেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ঙ) গর্ভধারণকারী মায়ের যদি হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতা বা ডায়াবেটিস থাকে। চ) গর্ভধারণকারী মায়ের যদি বিভিন্ন অভ্যাস থাকে। যেমন- মদ পান, ধূমপান করা, তামাক ব্যবহার করা ইত্যাদি।
প্রতিবন্ধী ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিদের মতে, প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি ক্রসকাটিং ইস্যু। তাই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদাকে বিবেচনায় এনে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার। অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতা সব মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনে। যাতায়াত, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও প্রবেশগম্য করা প্রয়োজন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষ প্রতিবন্ধীর তুলনায় নারী প্রতিবন্ধীর ক্ষেত্রে মৌলিক চাহিদা প্রাপ্তিতে অসমতার হার বেশি। সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও সমঅধিকার রাখে।
সরকারের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার কমতি নেই। তবু আমরা বলতে চাই, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারার বাইরে রাখা যাবে না। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানসহ সব কার্যক্রমের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।