আমাদের দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, এই শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ। আরো জানা যায়, এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বা ভর্তুকি কমানোর প্রথম ধাপে সরকার বিভিন্ন পণ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা কমিয়েছে। তৈরি পোশাক খাতের পাঁচটি পণ্যে প্রণোদনা বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা ইতিবাচক। তবে এতে রপ্তানিকারকরা ক্ষোভ জানান। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘তাদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে প্রণোদনা তুলে দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। ছয় মাস আগে ক্রয়াদেশ নেওয়া হয়। অর্ডার নেওয়া হয়েছিল প্রণোদনার ওপর ভিত্তি করে। এখন প্রণোদনা তুলে নিলে অর্ডার মার খাবে। নতুন করে ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে পুরো পোশাক খাত।’
প্রণোদনা বন্ধের সিদ্ধান্তে পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদও। তিনি এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার আগামী জুন মাস পর্যন্ত রহিত করার অনুরোধ জানান। সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করেছে। পোশাকশিল্পের ইনসেনটিভ তারা বন্ধ করেছে (কমিয়েছে)। এই পোশাকশিল্প আমাদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান চালিকাশক্তি। বর্তমানে যেখানে আমাদের ডলার সংকট এবং রপ্তানি আয়ের ওপর চাপ পড়েছে, সেই মুহূর্তে এই সার্কুলারটি আমি মনে করি আমাদের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক হবে।’
বলা বাহুল্য, আশির দশকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ রয়েছে। এসব দেশে বাংলাদেশে উৎপাদিত সিংহভাগ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। উপরোক্ত দেশগুলোই মূলত তৈরি পোশাকের বাজার। শুরু থেকে এসব দেশে বাংলাদেশ গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করে আসছে।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মার্কেট শেয়ার ছিল ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০২১ সালে ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর্থিক বিবেচনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের মার্কেট শেয়ার ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ ৮ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলো হচ্ছে– চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চতুর্থ স্থানে থাকা তুরস্ক ২০ বিলিয়ন ডলার, ভারত ১৭ বিলিয়ন ডলার, ইন্দোনেশিয়া ১০ বিলিয়ন ডলার, কম্বোডিয়া ৯ বিলিয়ন ডলার এবং আমেরিকা ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে।
আসলে সমস্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েও বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমছে। ডলার সংকটের কারণে সরঞ্জামাদি আমদানি করা যাচ্ছে না। নতুন করে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে গ্যাস–বিদ্যুতের সমস্যা তো আছেই। সেই অবস্থায় নতুন বাজারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, নতুন বাজারগুলোর মধ্যে একেক গন্তব্যের ভোক্তাদের চাহিদা একেক রকম, কমপ্লায়েন্স কিংবা শুল্ক কাঠামোও ভিন্ন। ফলে বাজারগুলোর সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আলাদাভাবে পরিচর্যা করতে হবে। সেখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রদর্শনী করা যায়। আবার বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড বা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণও জানানো দরকার। তাই প্রণোদনা বন্ধের সিদ্ধান্তে পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে এই খাত। অতএব, পোশাকশিল্পের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।