চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন এখন এক নির্বাচনী উৎসবের মাঠ। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আয়োজিত হতে যাওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে চারদিকে উচ্ছ্বাস, কৌতূহল আর সৃজনশীলতার ঝলক। শাটল ট্রেন থেকে শুরু করে ক্যাফেটেরিয়ার দেয়াল– যেদিকে চোখ যায়, দেখা মেলে রঙিন পোস্টার, ব্যানার আর হাস্যোজ্জ্বল প্রার্থীদের মুখ। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরপরই ক্যাম্পাসে নেমে আসে দুর্গাপূজার ছুটি। তবু থেমে থাকেনি নির্বাচনী আমেজ। প্রার্থীরা ছুটির সময়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালিয়ে গেলেন। আর ছুটি শেষে ক্যাম্পাস খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় অভিনব প্রচারণার হিড়িক।
চার ভাষায় প্রচার, সবার কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা : নির্বাচনে সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতায় সবার নজর কাড়েন মীর সুমাইয়া আহমেদ (লায়লা এল ফাউলি) নামে এক প্রার্থী, যিনি তার প্রচারপত্রে একসঙ্গে চারটি ভাষা ব্যবহার করেছেন। ভাষাগুলো হল– চাকমা, মারমা, চাটগাঁইয়া ও বাংলা। প্রচারপত্রের সামনের অংশে চার ভাষায় অভ্যর্থনা বার্তা, পেছনে ইশতেহার ও ওয়েবসাইটের সোর্স কোড। এ যেন ভাষার সেতুবন্ধন গড়ে তোলার এক অনন্য প্রয়াস। এমন প্রচারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসে নানা ভাষাভাষী শিক্ষার্থী আছেন। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতেই এই উদ্যোগ।
ভাষা নির্বাচনের বিষয়ে তার যুক্তি হল– চবিতে চাকমা ও মারমা শিক্ষার্থী তুলনামূলক বেশি, পাশাপাশি চাটগাঁইয়া ভাষাভাষীও রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তাই তিনটি আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা– সবাইকে একই সূত্রে বাঁধার প্রচেষ্টা হিসেবে। শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়াও বেশ ইতিবাচক। তিনি জানান, নিজেই করেছেন নিজের প্রচারপত্রের ডিজাইন। স্ট্রাকচারটা হাতে এঁকেছি, পরে কম্পিউটারে কাস্টোমাইজ করেছেন আরেক ভাই।
লিফলেট থেকে গানের সুরে সৃজনশীলতার জোয়ার : পুরো ক্যাম্পাস এখন যেন অভিনব আইডিয়ার প্রদর্শনী। কেউ প্রচারপত্র বানাচ্ছেন ডলার বা টাকার নকশায়, কেউ চায়ের কাপ বা হাতপাখার আদলে লিফলেট বিতরণ করছেন। কেউ আবার বিচারকের হাতুড়ির মতো লিফলেট বানিয়ে দৃষ্টি কাড়ছেন। ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাতে ঘুরছে এমন নানান রঙিন প্রচারপত্র, যা শুধু প্রচারণা নয় এক ধরনের শিল্পকর্মও বটে।
ছুটি শেষে ক্যাম্পাস খোলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেটের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কানে আসে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানের সুর। গানের কথায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, ব্যালট নম্বর আর হাস্যরস। এ যেন প্রচারণায় এক নতুন মাত্রা সংগীতের ছোঁয়ায় ভোটের ডাক। আবার রাতের শাটল যখন ক্যাম্পাসে পৌঁছায় তখন দেখা যায় ভিন্নচিত্র; সেখানেও দলে দলে ভাগ হয়ে গানের আড্ডায় প্রার্থীরা প্রচার করছেন নিজের নির্বাচনী ইশতেহার। শিক্ষার্থীরা শুনছেন গান ও নির্বাচনী ইশতেহার।
ডিজিটাল প্রচারণার দাপট : এবারের চাকসু নির্বাচনে মাঠের প্রচারণার পাশাপাশি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবেও চলছে প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন প্যানেল নিজেদের প্রচারণামূলক ভিডিও তৈরি করে বুস্ট করছে, পোস্টার ও ইশতেহার ডিজিটালভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ফেসবুক পেজে অনুসারীর সংখ্যা ইতিমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বতন্ত্র ‘শিক্ষার্থী সম্মিলন’, ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’, ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ সব প্যানেলই এখন সমানভাবে সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেক প্রার্থী ভিডিওর মাধ্যমে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছেন, কেউ বা কৌতুকের ছলে ভোট চাইছেন লাইভে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৫ অক্টোবর। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪১৫ জন প্রার্থী, আর ১৪টি হলে ৪৯৩ জন প্রার্থী লড়ছেন নিজেদের অবস্থান জানান দিতে।
এবারের নির্বাচনে মোট ২৭ হাজার ৫১৮ জন শিক্ষার্থী ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। আচরণবিধি অনুযায়ী, ভোটগ্রহণের ২৪ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর সকাল ৯টা পর্যন্ত প্রচারণা চালানো যাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখন শুধু নির্বাচনের অপেক্ষায় নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে। প্রচারণার এই রঙ, শব্দ, ভাষা ও সৃজনশীলতার মিশ্রণ প্রমাণ করে চবির শিক্ষার্থীরা শুধু ভোট নয়, ভাবছে নতুন এক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি গঠনের দিকেও।