প্যালেস্টাইনের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস বনাম বাস্তবতা

ড. মো. মোরশেদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:১০ পূর্বাহ্ণ

 

 

প্যালেস্টাইনের প্রতি সংহতি প্রকাশের আন্তর্জাতিক দিবস আজ। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবছর দিবসটি উদযাপনের আহ্বান জানায়। এর ১০ বছর পরে ১৯৮৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিশ্বের ইহুদিবাদী নেতারা ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীর মূল ভূখণ্ডে সমবেত হয়ে একতরফাভাবে তাদের স্বাধীনতা ষোষণা করেন এবং সাথে সাথে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ তাদের স্বীকৃত প্রদান করে। ইসরায়েলিদের রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকে তারা ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড একের পর এক দখল করে নেওয়ার লক্ষ্যে সামরিক আগ্রাসন পরিচালিত করে যাচ্ছে। আরবদের মধ্যকার অনৈক্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে। তাছাড়া ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বেরও রয়েছে বিশেষ সমর্থন এবং সহযোগিতা। অথচ ফিলিস্তিনিদের একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখন পর্যন্ত বাস্তব রূপ নিচ্ছে না। বিশ্বের মোড়ল শক্তিগুলো ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ফিলিস্তিনিদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমির প্রতিশ্রুত সীমা জাতিসংঘ নির্ধারণ করেনি, ইসরায়েল তা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। এই সংকট উভয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্রতর হতে থাকে। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) প্রতিষ্ঠা করে। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনইসরায়েলকে কেন্দ্র করে পরাশক্তি এবং আরবদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৯৯৩ সালে অসলোতে পিএলও এবং ইসরায়েল একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া এবং পর্যায়ক্রমে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। পিএলও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে ইসরায়েলের অস্তিত্ব মেনে নেয়। পিএলও নেতা হিসেবে ইয়াসির আরাফাত বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। তিনি ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করলে প্যালেস্টাইন আন্দোলন যোগ্য নেতৃত্বের সংকটে পড়ে। আপরদিকে আরব দেশগুলোর মধ্যেও নানা অনৈক্য দেখা দেয়। ইসরায়েল সেই সুযোগ গ্রহণ করে। ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবে আজও প্রতিষ্ঠা কিংবা স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে একটি চরম রাজনৈতিক সংকট জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ জনগণ।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাষ্ট্র এবং বিশ্ব পরাশক্তির মতামত অনুযায়ী, অধিকৃত ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা এখন দিন দিন অনিশ্চিতই হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেও এই দীর্ঘ সংঘাতময় অঞ্চলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নামে দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ক্রমেই যেন আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইহুদিবাদী ইসরায়েলি শাসকদের সমগ্র ফিলিস্তিনি আরব ভূখণ্ড গ্রাস করার অব্যাহত ষড়যন্ত্র, রাজতন্ত্রের অধীনে আরব শাসকদের অসহযোগিতা এবং বিশেষ করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিরক্ষাকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের অযৌক্তিক কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে ফিলিস্তিনবাসীর মুক্তির বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও শান্তিকামী নাগরিকের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। আরব ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনি অংশে অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনিদের ওপর একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া ইহুদিবাদীদের যুদ্ধের আগে জাতিসংঘের ঘোষিত সীমানায় কখন একটি পৃথক ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। বিগত প্রায় ৫০ বছরের ওপর ইস্যুটি নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ফিলিস্তিনি আরবদের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত এ ব্যাপারে সমস্যা সমাধানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত সমর্থ হননি।

ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত আছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে দিবসটি উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে একটি সার্বভৌম, স্বাধীন ও কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করি, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবসে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের জন্য তাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে অবিচল সংহতি পুনর্নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যোগ দিচ্ছে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বাংলাদেশের অবিচল সমর্থন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জোরালো আদেশের নিরিখে গঠিত হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশের সংবিধানে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা বা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ন্যায্য সংগ্রামে সারা বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর পক্ষে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দখলদার শক্তির সাম্প্রতিক নৃশংসতাসহ সকল ফিলিস্তিনির বিরুদ্ধে বেআইনি ও যুদ্ধংদেহী পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা অবিলম্বে অব্যাহত আগ্রাসন, অবৈধ বসতি নির্মাণ এবং ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলা বন্ধ করার আহ্বান জানাই।

২০২১ সালে দিবসটি উপলক্ষ্যে ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূূত ইউসেফ এস. ওয়াই. রামাদান বলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি বিশেষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে ১৯৭৩ সালে ফিলিস্তিনের জনগণের নিকট চিকিৎসা সামগ্রী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনের মানুষ সবসময়ই সংকটের মধ্যে আছে। দখল ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বহু বছরের সংগ্রামের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের সব নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের বেদনা দৃঢ়ভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীর সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশে পিএলওএর কার্যালয়ও খোলা হয়। ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র গঠনের অধিকারের পক্ষে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণ সবসময়ই সংহতি প্রকাশ করে এসেছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যে বক্তব্য রাখেন সেখানেও তিনি ফিলিস্তিনের প্রতি তাঁর দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ব্যক্ত করেন। ফিলিস্তিনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সেই সমর্থনের ঘোষণার প্রতি আজও বাংলাদেশ অবিচল রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তিতে ইয়াসির আরাফাত আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রলাভের অধিকারে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন প্রদান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে সবসময়ই বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পাশে থেকেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ফিলিস্তিনের জনগণের উপর সম্প্রতি ইসরায়েলের হামলা ও আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

ফিলিস্তিনি আরবদের পূর্বনির্ধারিত কিংবা জাতিসংঘ স্বীকৃত স্থানে পৃথক রাষ্ট্র গঠনে ইসরায়েলকে সম্মত হতে হবে। তবে একটি সুখবর হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল, ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিরতির কথা জানা গেছে। কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েলফিলিস্তিন সংঘাত অবসানে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সমর্থনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদি। ২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিদ্যমান কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও দুই রাষ্ট্রের জনগণের জন্য দুইটি রাষ্ট্রর ভিত্তিতে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি চুক্তি, ইসরায়েলের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও আমাদের শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য সঠিক হবে। তিনি আরও বলেন, এমন একটি চুক্তি (দুই রাষ্ট্র বাস্তবায়নের সম্ভাব্য চুক্তি) যা শান্তিপূর্ণ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে, যে রাষ্ট্র ইসরায়েলকে হুমকি দেবে না। বেশ কয়েক বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ প্রথম কোনো ইসরায়েলি নেতা ফিলিস্তিন প্রশ্নে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কথা উল্লেখ করেছেন। স্বস্তির বিষয় হলোদৃশ্যত প্রাণহানি ও রক্তক্ষয় আপাতত বন্ধ হয়েছে। এটি স্থায়ী হবে বলে আমরা আশা করতেই পারি। সেই সঙ্গে আরও প্রত্যাশা ফিলিস্তিনিরা স্বভূমি ফিরে পাবে এবং বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিবে।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনিয়ম আর দুর্নীতি থেকে কীভাবে রেহাই পাবে মানুষ!
পরবর্তী নিবন্ধবনফুল ২য় বিভাগ ফুটবল লিগের ফলাফল