পোশাকশিল্পে নৈরাজ্য বন্ধ অতীব জরুরি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

সফল ও সার্থক ছাত্রজনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সংঘটিত হলো গণঅভ্যুত্থান। বিপুল সংখ্যক প্রাণ বিসর্জন ও আহতদের আহাজারিতে দেশবাসী কঠিন ট্রমার মধ্যে রয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে অভিষিক্ত হয়েছেন। সরকারের মাস পূর্তিতে ছাত্রজনতার শহীদি মার্চ ছিল তারুণ্যের অপরাজিত উচ্ছ্বাসে ভরা। আন্দোলনে শহীদদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং আহতদের প্রতি সমবেদনা ও আশু আরোগ্য কামনা করে সকল মসজিদমন্দিরপ্যাগোড়ায় প্রার্থনা অব্যাহত রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। নব্য দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া নৈরাজ্যের কারণে চাঁদাবাজিদখলদারিত্বলুটতরাজ এখনও পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে হয় না। জনশ্রুতিমতে, নগরশহরগ্রাম্য জনপদে নানাভাবে মানুষ নির্যাতিতনিগৃহীত হওয়ার ঘটনাও নেহায়েত কম নয়। এরই মধ্যে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দেশে পাঠানো অর্থের যোগান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধিতে অনুপম ভূমিকা রাখছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা বিরাজিত। সংবাদ মাধ্যমের সূত্রমতে, বিগত কয়েকদিন ধরে আশুলিয়া, গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকায় রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভদাঙ্গাহাঙ্গামাভাঙচুরলুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষও ছিল দুঃখজনক। শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে উল্লেখ্য এলাকার পোশাকশিল্প ছিল কার্যত অচল। যেকোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিতবিরূপ পরিস্থিতি এড়াতে বন্ধ রাখা হয় একশ এর অধিক কারখানা। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, সরকারমালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পরও পোশাক শিল্পের শ্রমিক অসন্তোষ থামছে না। এর প্রভাবে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ছিল ১১৪ কারখানা। এর মধ্যে কারখানা চালানোর অনুকূল পরিবেশ না থাকায় এবং সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় সুরক্ষায় কারখানা শ্রম আইন ২০০৬ সালের ১৩ () ধারায় ৫৪ টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে মালিকপক্ষ। এ ধারায় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলে শ্রমিকরা বন্ধ সময়কালীন কোনো বেতন পাবে না।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্র অনুযায়ী, শ্রম আইন ২০০৬ সালের ১৩() ধারায় বন্ধ হয়েছে দেশের ৫৪ কারখানা। বেতনসহ বন্ধ করা হয়েছে ৬০টি। ১১ সেপ্টেম্বর কারখানা খোলা ছিল ২ হাজার ২৮টি। তাছাড়া পোশাক শ্রমিকদের আগস্ট মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৩০৯টি বা ৬১ শতাংশ কারখানায়। পোশাক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের দাবী, শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩() ধারা ঘোষণার ফলে শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়বে এবং তা জিইয়ে রাখতে তৃতীয় পক্ষ এর সুযোগ নিবে। বিনা মজুরীতে এই সময় সাধারণ ছুটি দিয়ে শ্রমিকদের আরো উসকে দেওয়া হলো। তৃতীয় পক্ষ বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনকে পুঁজি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করতে চাইছে। তাদের মতে, ‘কারখানাগুলোতে বিগত সরকারের নেতাদের হাতবদল হওয়া ঝুটটিফিন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সরবরাহ বাণিজ্যে জড়িত ব্যবসায়ীরা অন্যদলের নেতাদের সামনে এনে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিভিন্ন কারখানায় ছোটখাট কিছু সমস্যা বিদ্যমান। এটা আগেও ছিল, এখনও আছে। বিজিএমইএ’র সার্বিক তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে সকল সমস্যা সমাধানে তড়িৎ উদ্যোগ গ্রহণই এই শিল্পের জন্য মঙ্গলজনক।’ শ্রমিক নেতৃবৃন্দদের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নাগালে আনতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদার করার পাশাপাশি কারখানাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাদিগও দেওয়া হয়েছে।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশিবিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই শিল্পকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করছে। এর মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। যারা বিভিন্ন কায়দায় শিল্পে নৈরাজ্যকর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে তারা কেউ শ্রমিক না, সবাই বহিরাগত। ৪০৫০ জন লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে মালিকেরা বাধ্য হয়ে কারখানা ছুটি ঘোষণা করে। এর ফলে প্রতিদিন পোশাক উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্ডারের মালামাল বুঝিয়ে দিতে না পারলে ক্রেতারা দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। পোশাক খাতের রপ্তানি অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্য দেশে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নানা অজানা শঙ্কায় নিপতিত।

প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্প কঠিন সময় অতিক্রম করছে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে একদিকে কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টে হামলা, ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ করা হচ্ছে। এ বিক্ষোভের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের দূরতম সম্পর্কও নেই। শ্রমিকদের উচিত কারো প্ররোচনায় পড়ে কারখানায় ভাঙচুর না করা। শ্রমিকদের যেকোনো ন্যায্য দাবি সরকারশ্রমিকমালিকরা কারখানার অভ্যন্তরে বসে সমাধানে প্রস্তুত আছে। এসব দাবি কারখানাতেই সমাধান সম্ভব। রাজপথে সমাধান নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতিও পঙ্গু হবে।’

আমাদের সকলের জানা, দেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আহরিত হয় তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে। শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারমালিককর্মকর্তাকর্মচারি ও শ্রমিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বল্পমূল্যে পণ্যের অর্ডার সংগ্রহউৎপাদন এবং বৈশ্বিক বাজারজাতকরণে বাংলাদেশ উচুমার্গে প্রতিষ্ঠিত। সৌহার্দসম্প্রীতিপারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এই শিল্পের প্রসার ও বিস্তার কর্মসংস্থানের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দেশব্যাপী কর্মক্ষম মহিলাদের কর্মযোগী করার অপার সম্ভাবনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে এই শিল্প সর্বত্রই সমাদৃত। কমঅর্ধ বা অশিক্ষিত মহিলারা স্বল্প সময়ের মধ্যে কারিগরি দক্ষতায় নিজেদের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে এই শিল্পকে করেছে অধিকতর সমৃদ্ধ। বিশ্ববাজার ব্যবস্থা পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, নানা প্রতিকূলতা ও অসম প্রতিযোগিতার কাঠিন্যে দরকষাকষির মোড়কে মালিক পক্ষ বিদেশ থেকে ক্রয়াদেশ সংগ্রহরপ্তানিজাত কর্মযজ্ঞে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশসমূহের সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ একক দেশ হিসেবে ২য় স্থানে অধিষ্ঠিত।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বাজার হিস্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ২০২২ সালে ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে যা বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানির ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালে বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হিসাব মতে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের ২০২২ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে দেশটির বাজার হিস্যা ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বিপরীতে ২০২২ সালে হয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বরাবরের মতো বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে আছে চীন। ২০২২ সালে চীন ১৮২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে যা মোট বাজারের ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের তুলনায় দেশটির বাজার হিস্যা কমেছে।

পোশাকশিল্পে এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে বিদেশি ক্রেতারা পণ্য আদেশ বাতিল বা নতুন করে কার্যাদেশ দেয়া নিয়ে সংশয়ে থাকবে। বিগত পতিত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুটেরারা ব্যাংক সমূহে চরম আর্থিক সংকট তৈরি করেছে। বিশাল ঋণ খেলাপির আড়ালে অর্থপাচারের কদর্য দৃশ্যাদৃশ্য ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শিল্প মালিকেরা নতুন করে ঋণ নিতে প্রায় অপারগ। পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিয়মিত বেতনসুবিধাদি প্রদান ও উৎপাদন গতিশীল রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অদৃশ্য অশুভ শক্তির চক্রান্তষড়যন্ত্রের গ্যাঁড়াকলে পড়তে যাচ্ছে পোশাক শিল্প। বিদেশি ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করে বাংলাদেশের বাজার দখলে অন্যকোন দেশের অপতৎপরতা কার্যকর কিনা গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র অনুধাবন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

বিজ্ঞজনদের মতে, পোশাকশিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার আগে সরকার এবং প্রশাসনের উচিত এ সংকটের দ্রুততর সমাধান করা। সংশ্লিষ্ট কারখানা মালিকদের ব্যাংক থেকে দ্রুত ঋণ পেতে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা অধিকমাত্রায় প্রশংসিত। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও পোশাক শিল্পের মালিকরা শিল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অধিক সংখ্যক শিল্প পুলিশ নিয়োগের অনুরোধ করেছেন। পোশাক শিল্পের শৃঙ্খলা ফেরাতে সেনা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর যৌথ অভিযানে পূর্ণাঙ্গ সচলতা বজায় রাখার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধকাল কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবারে জশনে জুলুস