বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যে সর্বজনীন পেনশনের পঞ্চম স্কিম ‘প্রত্যয়’ নিয়ে একটি অভয় বাণী দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। এক বার্তায় জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, গত ৩০ জুনের আগে চাকরিতে যোগদানকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নতুন স্কিমে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
আগের ঘোষণা অনুযায়ী চলতি ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই প্রত্যয় স্কিম চালু হয়েছে। তাতে যুক্ত হলে অবসর পরবর্তী আর্থিক সুবিধা কমে যাওয়ার শঙ্কায় আন্দোলনে নেমেছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা। এ পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ থেকে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় এর শুভযাত্রা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের স্পষ্টীকরণ’ শীর্ষক বার্তা পাঠানো হয়। এদিকে প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মূল ফটকে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচিতে ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া এ ঘোষণা দেন। খবর বিডিনিউজের।
পেনশন কর্তৃপক্ষের বার্তায় বলা হয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থায় আনার লক্ষ্য নিয়েই স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত এবং তার অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রত্যয় স্কিম চালু করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪০৩টি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৯০টির মতো প্রতিষ্ঠানে পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের (সিপিএফ) আওতাধীন। সিপিএফ সুবিধার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা এককালীন আনুতোষিক পান, পেনশন পান না।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ একটি সুগঠিত পেনশনের আওতার বাইরে থাকায় সরকার সব শ্রেণি–পেশার মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ এর ১৪ (২) ধারা অনুযায়ী, ১ জুলাই ২০২৪ বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানকারী সব কর্মচারী বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিমের আওতাভুক্ত হবেন। অর্থমন্ত্রীও তার বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি বলেছেন।
তবে আন্দোলনে থাকা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বলছে, শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত বৈষম্যমূলক। কারণ বর্তমানে পেনশনের জন্য তাদের বেতন থেকে অর্থ কাটা না হলেও নতুন নিয়মে ১০% কাটা হবে। এখন যে আনুতোষিক পাওয়া যায়, প্রত্যয় স্কিমে তা নেই। চাকরিজীবী এবং তার নমিনি এখন আজীবন পেনশন পান, প্রত্যয়ে যুক্ত হলে সেটাও কমবে। বর্তমান নিয়মে পেনশনাররা মাসে চিকিৎসা ভাতা, দুটো উৎসব ভাতা পান, একটি বৈশাখী ভাতা পান, প্রত্যয়ে সে ব্যবস্থা নেই। এখনকার মতো ইনক্রিমেন্টও নেই।
শিক্ষকদের আশ্বস্ত করতে প্রত্যয় স্কিমের কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের বার্তায়। ১. ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব শিক্ষক/কর্মকর্তা–কর্মচারী চাকরিতে আছেন, তারা আগের মতো সব পেনশন সুবিধা পাবেন। ২. বর্তমানে সরকারি পেনশনে ‘আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট’ সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ফলে পেনশনের যাবতীয় ব্যয় প্রয়োজন অনুযায়ী জাতীয় বাজেট বরাদ্দ থেকে মেটানো হয়। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ‘ফান্ডেড ডিফাইন্ড কনট্রিবিউটরি’ পদ্ধতির পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সে কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাসিক জমার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, যেটা কম হয়, তা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। সেই টাকা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কর্মকর্তা–কর্মচারীর কর্পাস হিসাবে জমা করবে।
৩. ‘আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট’ সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে কোনোক্রমেই টেকসই ব্যবস্থা নয়। অপরদিকে ‘ফান্ডেড ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউটরি’ পেনশন সিস্টেমে প্রাপ্ত কন্ট্রিবিউশন এবং বিনিয়োগ মুনাফার ভিত্তিতে একটি ফান্ড গঠিত হয় বলে দীর্ঘমেয়াদে এটি একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থা। ভারতেও ২০০৪ সাল থেকে ফান্ডেড কন্ট্রিবিউটরি পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।
৪. নতুন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব শ্রেণি–পেশার মানুষকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। ৫. কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে বা উচ্চতর কোনো পদে নিয়োগ পেলে তিনি সার্ভিস প্রটেকশন ও পে প্রটেকশন পান বলে সেটি নতুন নিয়োগ হিসাবে গণ্য করা হয় না। সেক্ষেত্রে তার বিদ্যমান পেনশন সুবিধার আওতায় থাকার সুযোগ থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী যারা ২০২৪ সালের ১ জুলাই এবং তার পরে নতুন নিয়োগ পাবেন, কেবল তারা প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
৬. সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশনপ্রাপ্তির কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছরে অবসরে যাবেন বলে তখন থেকে আজীবন পেনশন পাবেন। এক্ষেত্রে সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে।
৭. লাম্পগ্রান্ট, পিআরএল ও প্রভিডেন্ট ফান্ড বর্তমান ব্যবস্থায় বহাল থাকবে। ৮. কন্ট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেমে অংশগ্রহণকারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এককালীন নয় বরং মাসিক পেনশনের যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ নির্ধারণ করাই অগ্রগণ্য। সে কারণে এক্ষেত্রে আনুতোষিকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি বরং বিদ্যমান মাসিক পেনশনের কয়েক গুণ বেশি মাসিক পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন থেকে কাটা হলে, একই পরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান জমা করলে ৩০ বছর পর একজন পেনশনার প্রতি মাসে ১,২৪,৬৬০ টাকা হারে আজীবন পেনশন পাবেন। তার নিজ আয়ের মোট জমা অর্থের পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা। আর তিনি যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান, সেক্ষেত্রে তার মোট প্রাপ্তি হবে ২ কোটি ২৪ লক্ষ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা যা তার জমার প্রায় ১২ দশমিক ৫ গুণ। পেনশনার পেনশনে যাবার পর ৩০ বছর জীবিত থাকলে তার জমার প্রায় ২৫ গুণ অর্থ পেনশন পাবেন।
৯. বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার আজীবন পেনশন পান। তার অবর্তমানে পেনশনারের স্পাউস এবং প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পান। নতুন পেনশন ব্যবস্থায়ও পেনশনার আজীবন পেনশন পাবেন। পেনশনারের অবর্তমানে তার স্পাউস বা নমিনি পেনশনারের পেনশন শুরুর তারিখ থেকে ১৫ বছর হিসাবে যে সময় অবশিষ্ট থাকবে সে পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন। যেমন একজন অবসরে যাবার পর ৫ বছর পেনশন পেয়ে তারপর মারা গেলে, তার স্পাউস বা নমিনি আরো ১০ বছর পেনশন পাবেন।
ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান শিক্ষকদের, আন্দোলন চলবে : সর্বজনীন পেনশনের পঞ্চম স্কিম প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মূল ফটকে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচিতে ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার করে আগামী বছর ‘সেবক’ নামে স্কিম চালু হলে এবং সেখানে সবার জন্য সুযোগ–সুবিধা রাখা হলে আমরা সেখানে যাব। দেশের স্বার্থে সবার জন্য যা হবে, আমাদের জন্যও তা হবে। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু প্রত্যয় স্কিম বাতিল করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবি আবারো তুলে ধরেন তিনি।
পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? আমরা এতদিন বিবৃতি–স্মারকলিপি দিয়েছি, সংবাদ সম্মেলন করেছি। সাড়ে তিন মাস আগে যদি আমরা জানতাম বয়সসীমা ঠিকই আছে, তাহলে শিক্ষকরা এত ক্ষুব্ধ হত না। এখন আন্দোলন স্তিমিত করার জন্য একটা ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের আমরা বিশ্বাস করি না। ২০১৫ সালে যেভাবে তারা আমাদের রাস্তায় নামিয়েছে। সুপার গ্রেড আমাদের দেয়নি। সে সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, একটি কমিটিও হয়েছে। তবে নয় বছরেও আমরা সুপার গ্রেড পাইনি। তখনও আশ্বাস দিয়েছে। সুতরাং আশ্বাস দিলে হবে না। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে নিয়ে বসতে হবে। আমাদের সুপার গ্রেড দিতেই হবে। আপনারা আগামী বছর সেবক আনবেন, সেবকে কী সুযোগ সুবিধা আছে, সেটা আমরা দেখব। সর্বজনীন হলে আমরা কেন যাব না? কিন্তু আমরা আলাদাভাবে যাব না সেখানে।
শিক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস–পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলেও এই শিক্ষক নেতা জানান।