নষ্ট রাজনীতি, দুর্বৃত্তায়িত ভোগবাদী সমাজের বিকৃত দাপটে বিপর্যস্ত, সাম্প্রদায়িক পরিচিতির প্রাধান্যে বিভক্ত সমাজে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি যখন মুনাফালোভী ব্যবসার হাতিয়ার, তখন আত্মনিবেদিত, বিপ্লবী রাজনীতির শুদ্ধতম কতক বিপ্লবী অগ্রজের জীবন কথা আগুনের পরশমণির মতো আমাদের ছুঁয়ে যায় সময়ের এই গাঢ় অন্ধকারে। তৎকালীন চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা বিপ্লবী রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, আইনজীবী, বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক, প্রথম প্রজন্মের কমিউনিস্ট নেতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
চট্টগ্রামের বিপ্লবী বাম রাজনীতির আজ পর্যন্ত প্রায় ৮০ বছরের ইতিহাসে কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মত সর্বজনগ্রাহ্য ও শ্রদ্ধেয় জননেতা (Public Figure ) আর উঠে আসেননি। তিনি জীবিত অবস্থায় এক রাজনৈতিক কিংবদন্তীতে পরিণত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বোয়ালখালী পটিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে কারাগারে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচনে পটিয়া থেকে ন্যাপ প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রচন্ড জোয়ারের মধ্যেও জিততে জিততে মাত্র ৪০০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান বা বলতে গেলে পশ্চিম পটিয়ার ৩টি কেন্দ্র ছিনতাই করে জোর করে তাঁকে হারিয়ে দেয়া হয় যা তখনকার চট্টগ্রামের সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের বিব্রত করে। সেই নির্বাচনের ৬ মাসের মাথায় অসুস্থ শরীর নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য দুর্গম পার্বত্য পথ অতিক্রম করে ভারতে যাবার পথে তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। ৬২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে ৩২ বছর তিনি ছিলেন কারান্তরালে। শৈশব কৈশোর বাদ দিলে জীবনের সামান্য ক’বছরে তিনি একজন বিপ্লবী হিসেবে, একজন বিদগ্ধ লেখক হিসাবে, একজন দেশবরেণ্য জননেতা হিসাবে যেভাবে মানুষের সম্মান ও সমীহ আদায় করতে পেরেছিলেন তা বলতে গেলে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। “স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম” নামে তাঁর লিখিত বিখ্যাত আকর গ্রন্থটি হল মাষ্টার দা’র নেতৃত্বে সংঘটিত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ তথা জালালাবাদ যুদ্ধের একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। এই গ্রন্থ সারাদেশে সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলা একাডেমি ১৯৬৭ সালে এই বই প্রকাশের জন্য তাঁকে দু’হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে। একই সাথে চট্টগ্রামের বিপ্লবী কন্যা তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা “বীর কন্যা প্রীতিলতা”, তাঁর রচিত আরেকটি ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক দলিল। তাঁর উন্নত সাহিত্যিক রুচি ও সাবলীল গদ্য যে কোন পাঠককে মুগ্ধ করবে।
পূর্ণেন্দু বাবু ছিলেন প্রচার বিমুখ অন্তর্মুখী অথচ বিদগ্ধ একজন লেখক ও বিপ্লবী। জেল খানায় বসে তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন। বিশ্বখ্যাত গল্পকার মোঁপাসা ও চেখভের গল্প যেমন অনুবাদ করেছেন তেমনি দু’একটি বিদেশী উপন্যাস ও অনুবাদ করেছেন। পার্ল বাকের বিখ্যাত উপন্যাস The House Divided বাংলা অনুবাদ করেন। “স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম” ও “বীর কন্যা প্রীতিলতা” নামে বিপ্লবী ইতিহাস আশ্রিত বই দুটো তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। কিন্তু এই দুই বইয়ের কোথাও তাঁর নিজের নাম নেই বা কোথাও তাঁর বিশাল বিপ্লবী কর্মকান্ডের বিবরণ নেই। প্রীতিলতার বইটি পড়ে বোঝার উপায় নেই যে এই বিপ্লবী নারীর ‘ফ্রেন্ড, ফিলসফার এন্ড গাইড’ ছিলেন এই প্রচার বিমুখ লেখক নিজেই। উদার, নিস্পৃহ, অর্ন্তমুখীনতার এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর ছিলেন পূর্ণেন্দু দস্তিদার। বাংলা একাডেমি ১৯৭২ সালে শ্রেষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থ হিসাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম বইটিকে অবশেষে পুরস্কৃত করে।
প্রীতিলতাকে নিয়ে লেখা বইয়ে তাঁর ভূমিকা পড়ে আমরা তাঁর শিল্পী সত্তার পরিচয় পাই। তিনি সেখানে লিখেছেন প্রীতিলতার অত্যন্ত বিবর্ণ এবং অস্পষ্ট একটি ছবিকে তিনি নিজ হাতে স্কেচ করে আজকের ছবিতে রূপ দিয়েছেন। অনেকেই জানেন না মাষ্টার’দার আজকের বহু প্রচলিত ছবিটিও তাঁরই স্কেচ করা। তাছাড়াও জেলখানায় বসে বসে তিনি লেনিন, মার্কসসহ বিভিন্নজনের ছবি স্কেচ করতেন। বাংলার জনপ্রিয় লোক সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে রচিত কবিয়ালদের কবিগান তাঁকে মু্গ্ধ করত। তিনি সেকালের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রমেশ শীলকে বুদ্ধি ও উপদেশ দিয়ে কবি গানের সৃজনশীল বিকাশে সহায়তা করেছিলেন। জনপ্রিয় কবি গানকে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামের হাতিয়ারে পরিণত করতে উজ্জ্বীবিত করেন কবিয়ালদের। রমেশ শীলরাও পাল্টে যান নতুন কাব্যিক ভাবনায়। রমেশ শীল, ফনিবড়ুয়া ও রাই গোপাল চট্টগ্রামের এই তিন শ্রেষ্ঠ কবিয়ালকে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টিতেও নিয়ে আসেন। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা “কবিয়াল রমেশ শীল” গ্রন্থটি কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীলের জীবন, কর্ম ও কবিগান নিয়ে লেখা একটি অমূল্য গ্রন্থ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই মহৎ ও প্রতিভাবান লেখক ও শিল্পীসত্তা আজকের তরুণদের কাছে অনেকটাই অপরিজ্ঞাত, বয়স্কদের কাছে প্রায় বিস্তৃত।
পূর্ণেন্দুবাবু কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে রাজনীতির প্রয়োজনে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। কিন্তু সমস্ত সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাতে স্থিত হতে পারেননি। কারাগার ছিল অনেকটা তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে কোর্টে যেতেন আবার রাজনীতির ব্যস্ততার কারণে বা পুলিশের কারণে যেতেই পারতেন না। তিনি আত্মগোপনে যেতে পছন্দ করতেন না বলেই বার বার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। আবার আদালতে গেলে যে মামলাগুলো পরিচালনা করতেন সেগুলোর অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক। ফলে তিনি সব মিলিয়ে কখনো আইন ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারেননি। সার্বক্ষনিক রাজনীতিবিদ তিনি ছিলেন না বটে তবে রাজনীতিই ছিল মূলত তাঁর পেশা। রাজনীতি তাঁর সুপ্তপ্রতিভা বিকশিত করে তাঁকে পরিপূর্ণ এক বিপ্লবী মানুষ রূপান্তরিত করেছে।
১৯০৯ সালে পূর্ণেন্দু বাবু পটিয়ার ধলঘাটের বিখ্যাত দস্তিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই পরিবারে তিনি ছিলেন সবার বড়। এই দস্তিদার পরিবার শুধু চট্টগ্রামে নয় সারা বাংলাদেশে ছিল একটি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক পরিবার। তাঁরা দুই ভাই, তিনি ও তাঁর অনুজ অর্ধেন্দু দস্তিদার ছিলেন মাষ্টার দা’র ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। অর্ধেন্দুবাবু জালালাবাাদ যুদ্ধে শহীদ হন। আরেক অনুজ সুখেন্দু দস্তিদার ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা ও সংগঠক। ছাত্রাবস্থায় তিনি গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই এসসি পাস করে সম্ভবত ১৯২৮ সালের দিকে তিনি যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। সেখানেও তিনি গোপন সশস্ত্র তৎপরতার সাথে যুক্ত হন। এখানেই বেথুন কলেজে পড়ার সময় প্রীতিলতাকে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। তিনি কিন্তু ইতোমধ্যে পুলিশের নজরে পড়ে যান এবং কিছু দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে যান। ফলে তাঁর আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হলো না। তিনি জেল থেকেই বি.এ পাশ করেন ও পরে বি.এল ডিগ্রি নেন। জেলে থাকার সময়েই তিনি প্রথমে ফরোয়ার্ড ব্লক ও পরে কমিউনিষ্ট কনসলিডেশন এ যোগ দেন ও পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা পাটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের দূর্ভিক্ষের সময় ও পরবর্তীতে তিনি পার্টির কাজে সারা চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছেন। সম্ভবত ১৯৪৩ সালে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রথম কংগ্রেসে সম্ভবত তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তিনি পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান হবার পর পরই ১৯৪৮ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৪ সালে পার্টির প্রার্থী হিসাবে জেল থেকে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হলেও তিনি আরো দুবছর পরে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পান। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারীর পর দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেল খানায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৬২ সালে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সালে গণঅভুত্থানের প্রেক্ষাপটে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
পূর্ণেন্দু বাবু একজন তত্ত্ববাগীশ কঠোর নীতিনিষ্ঠ ও খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ কমিউনিষ্ট বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অনেকটা আত্মভোলা ও আবেগ প্রবণ মানুষ। সারাটা জীবন এক ধরনের বেহিসাবী জীবন যাপন করেছেন। এক উদার নিস্পৃহ আত্মমগ্ন চৈতন্যে ডুবে থাকা নৈব্যক্তিক শিল্পী সত্তার অধিকারী এই বিপ্লবী দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাস তার আপন গতিতে এবং অনিবার্যভাবেই একদিন মুক্তির মোহনায় উপনীত হবে। তিনি তাঁর লেখায়, কথায়, কাজে সেই প্রত্যয় নানাভাবে নানা আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশের মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে মূল শত্রু সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি আপসহীন সংগ্রাম জারী রেখেছিলেন সারা জীবন। তাঁর আমৃত্যু লালিত এই বিপ্লবী বিশ্বাস ও দৃঢ়তার জন্য তিনি আজো সমান প্রাসঙ্গিক।
তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক বিশ্ব বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ছিলেন। “স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম” গ্রন্থে প্রথম অধ্যায়ের শেষে বিশ ও তিরিশের দশকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র গোপন আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাবে লিখেছেন “রামমোহন, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, প্রমুখ বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ দেশের সর্বাঙ্গীন মুক্তির জন্য বিভিন্নভাবে যে প্রেরণা সঞ্চার করেন মুক্তিঞ্চল মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী তরুণ তা আকন্ঠ পান করেন….। বাংলার বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রধান অংশ যখন আবেদন নিবেদনের অবমাননাকর পদলেহী নীতি গ্রহণ করেছিল তখনই বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালী তরুণ ঐ অবৈজ্ঞানিক সন্ত্রাসবাদের পথ গ্রহণ করেছিল। সেই পথ ছিল বন্ধুর, সে পথে ছিল অত্যাচার, জেল, গুলি, ফাঁসির দড়ি …………। তবু দলে দলে তারা যে এগিয়ে গিয়েছিল তার মূলে ছিল মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য সর্বস্ব পন করা ও নিজের মহামূল্যবান জীবনকে স্বাধীনতার বেদীমূলে উৎসর্গ করার অদম্য কামনা।”
আসলে এই কথামালা তাঁর নিজের অন্তর থেকে উৎসারিত এক আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তি। পূর্ণেন্দু বাবু জেনে শুনে এক কঠিন পথে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। হিজলী জেলে বন্দী পূর্ণেন্দু বাবুকে প্রীতিলতা মাঝে মধ্যে কবিতা লিখে পাঠাতেন। একটি কবিতায় প্রীতিলতা লিখেছেন- “আঁধার পথে পাড়ি দিলাম/মরণ-স্বপন দেখে।” পূর্ণেন্দু বাবুও স্বাধীনতা ও মানব মুক্তির সোনালী স্বপ্নে সমাজতন্ত্রের বেদীমূলে নিঃশেষে আত্মনিবেদন করেছিলেন এক “মরণ স্বপন দেখে”। তাঁর এই মহান আত্মহুতির অনির্বান শিখায় তরুণ প্রজন্ম আজকের বিভাজনের এই গভীর আঁধারে প্রাণিত হোক। আসুন তাঁর মত সমস্ত সংকীর্ণতা ও জেদ পরিত্যাগ করে সবাইকে নিয়ে সব মত ধারণ করে মুক্তমনে বিপ্লবের সেই হোমানলে সকলে পরিশুদ্ধ হই।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট