চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। ৭৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বেশ কয়েকজন জামায়াত–বিএনপি ও বিতর্কিতদের নাম দেখে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। বিতর্কিতদের কমিটি থেকে বাদ দেওয়ারও দাবি উঠেছে।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা আজাদীকে বলেন, আগে কখনো আওয়ামী লীগ করেননি এমন ব্যক্তিকে সহসভাপতিসহ সম্পাদকীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। আগে শিবির করেছেন এমন ব্যক্তিকেও কমিটিতে দেওয়া হয়েছে পদ। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া একজনকেও কমিটিতে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি–জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের একসময়ের সক্রিয় একাধিক সদস্যও উপদেষ্টা হয়েছেন।
কমিটির দুজন সহসভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে আজাদীকে বলেন, ঘোষিত কমিটিতে সিনিয়র–জুনিয়র মানা হয়নি। জুনিয়রকে করা হয়েছে সহসভাপতি আর সিনিয়র বীর মুক্তিযোদ্ধাকে করা হয়েছে সদস্য। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
দক্ষিণ জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর ফেইসবুকে চলছে সমালোচনা। কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম টুকু তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ করেনি এমন ব্যক্তিকে বড় পদ–পদবী দিয়েছে, আর রাশেদ মনোয়ার (পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক) দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।’
বাঁশখালী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক লীগ বাঁশখালী পৌরসভার সাধারণ সম্পাদক এইচ এম মিজানুর রহমান ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, নবগঠিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে এমন এক ব্যক্তিকে সহসভাপতি করেছেন, উনার ব্যবসায়ী অফিসে সবসময় আওয়ামী লীগবিরোধী সমালোচনা করেন! জীবনে কোনো জায়গায় বা কোনো সময় একবারের জন্য ‘জয় বাংলা’ বলেন নাই। উনার অফিসের ৯ম পৃষ্ঠার ৪র্থ কলাম
কর্মকর্তারা উনার কোম্পানির টাকায় কেনা গাড়ি ও তেল দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি থাকার পরও আওয়ামী লীগবিরোধী লোককে কিভাবে সহসভাপতি করা হলো এই বিষয়টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিবেচনার জন্য অনুরোধ রইলো।’
জুলধা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নুরুল হক চৌধুরী ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘এটাই তো বর্তমান ট্র্যাডিশন লিডার, হাইব্রিডদের মাই ম্যান নীতি। রাজনীতি করে আসা মানুষগুলো কারো মাই ম্যানের মধ্যে পড়ে না। এখন রাজনীতিতে মাই ম্যান নতুন আমদানি।’
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এস এম ছালেহ লিখেছেন, ‘কমিটির নামে অকমিটি–কমিটি আর ধান্দাবাজি রাজনীতির নামে অপরাজনীতি।’ এমন অনেক নেতাকর্মী ফেইসবুকে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও পটিয়া পৌরসভার মেয়র মো. আইয়ুব বাবুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে যারা শত জেল–জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করে দক্ষিণ জেলায় রাজনীতি করেছেন, আজকে আওয়ামী লীগের সুদিনে তারা কমিটিতে নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা আশা করেছিলাম যারা আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে, রগ কেটে দিয়েছে, আমাদের মিছিল–সভায় হামলা করেছে, ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি, তাদের বিচার হবে। কিন্তু দক্ষিণ জেলা কমিটিতে দেখলাম সেইসব প্রতিক্রিয়াশীলের অনেককেই পুরস্কৃত করা হয়েছে। তারা ক্ষমতার লোভে কৌশলে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে। তারা দলের দুর্দিনে কখনো দলের পাশে দাঁড়াবে না। তখন তারা পুরনো চেহারায় তাদের আদর্শের জায়গায় চলে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, দক্ষিণ জেলার কমিটিতে দলের দুর্দিনে সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়ন হবে। কিন্তু তা হয়নি। আমরা সাবেক ছাত্রনেতারা আশাহত হয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি। কমিটি ঘোষণার পর থেকে তৃণমূলে চরম ক্ষোভ এবং অসন্তোষ চলছে। জামায়াত–শিবিরের মতো একটি প্রতিক্রিয়াশীল, স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনের শীর্ষ পদের একজনকে সরাসরি জেলা কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।
আইয়ুব বাবুল বলেন, যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া একজন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। জামায়াত–বিএনপি ও বিতর্কিতদের কমিটিতে রাখায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। এছাড়া আওয়ামী লীগ বিরোধীদের উপদেষ্টা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি–জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক ড. এএইচএম সেলিম উল্লাহ। আরেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেনও একসময় বিএনপি–জামাতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সদস্য ছিলেন বলে প্রচার আছে।
একই ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক খোরশেদ আলম। তিনি আজাদীকে বলেন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণার পর কমিটির বেশ কয়েকজনকে নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে চরম বিতর্ক শুরু হয়েছে। জামায়াত–শিবির করত এমন দুইজন কমিটিতে এসেছে। যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে এমন একজনও কমিটিতে সদস্য পদে এসেছে।
তিনি বলেন, এ রকম প্রথমবারের মতো কমিটিতে স্থান পাওয়া দুই–তিনজনকে নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। যেমন জেলা কমিটিতে প্রথমবারের মতো ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন। তিনি কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করতেন। তিনি ২০২২ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাদের নৌকার প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস ভাইয়ের বিরুদ্ধে আনারস প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আমরা চাই, যারা বিতর্কিত, যাদের নিয়ে দলের ভেতরে–বাইরে সমালোচনা শুরু হয়েছে, তাদের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। আমরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে এই দাবি করছি।
খোরশেদ আলম বলেন, যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া একজনকেও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য করা হয়েছে। কমিটিতে সিনিয়র–জুনিয়র মানা হয়নি। জুনিয়র কয়েকজনকে কমিটির সহসভাপতি করা হয়েছে। এখন আমরা কমিটির মিটিংয়ে কীভাবে যাব? আমাদের লজ্জা লাগছে।
৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির ঘোষণার দুদিন পর ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম সভা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। সভায় তৃণমূল থেকে জেলা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা। এছাড়া সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে সংগঠনকে আরো গতিশীল করান আহ্বান জানিয়েছেন।