চট্টগ্রাম কাস্টমসে পেপারলেস ট্রেড বা পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন সিস্টেম চালু করাটাই যেন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অটোমেশনের অংশ হিসেবে গত ১ জানুয়ারি থেকে সব ধরনের শুল্ক পরিশোধ পে–অর্ডারের পরিবর্তে অনলাইনে (ই–পেমেন্ট) করা হয়। কিন্তু অনেক সময় সকালে ই–পেমেন্ট করে বিকেলেও শুল্ককর পরিশোধের কনফার্মেশন ম্যাসেজ পাচ্ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মাঝে মাঝে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অ্যাসাকুইডা সিস্টেমে ত্রুটির কারণে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করতেও বেগ পেতে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
আমদানি–রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন ব্যবস্থা চালু না হওয়ার ফলে এখনো আমদানিকারকদের ফাইল নিয়ে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ধর্ণা দিতে হচ্ছে। এতে সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি পণ্য খালাসেও দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কাস্টমসের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তারাই চান না, কাস্টমসে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন চালু হোক। পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন হয়ে গেলে ৯০ শতাংশ ফাইল প্রথা উঠে যাবে। অর্থাৎ পেপারলেস ট্রেড শুরু হলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ফাইল জিম্মি করে উৎকোচ আদায়ও বন্ধ হয়ে যাবে।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসে অটোমেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয় মূলত সেই ১৯৯৪ সালে। সেই সময় নির্দিষ্ট কিছু তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে গত ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকায় বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আধুনিক প্রযুক্তির অটোমেশন অ্যাসাইকুডা প্লাস সফটওয়্যার উদ্বোধন করা হয়। পরে সফটওয়্যারের কিছু দুর্বলতা থাকায় গত ২০১৩ সালে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার চালু করা হয়। পরে ধাপে ধাপে কাস্টমসের সকল কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি রিগ্যান দৈনিক আজাদীকে বলেন, অটোমেশন মানে হলো পেপারলেস একটি ব্যবস্থা। যেখানে স্টেকহোল্ডাররা ঘরে বসে প্রয়োজনীয় নথি আপলোড করে কাজ করতে পারার কথা। এখন সেই জায়গাতে কাস্টমসের কর্মকর্তারা সবকিছু ফাইলে দেয়ার কথা বলেন। এতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে অটোমেশন কার্যক্রম শুরু হয়, সেটি অন্ধকারেই রয়ে গেছে বলা যায়। আমরা অনেক আমদানি পণ্যের অনলাইনে বিএসটিআই’য়ের মান পরীক্ষার সনদ নিয়ে থাকি। অনলাইনে সনদ থাকার পরেও কাস্টমস কর্তারা সেটি ফাইলে দেখতে চান। এছাড়া গত ১ জানুয়ারি থেকে শুল্ককর পরিশোধের ক্ষেত্রে ই–পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করে এনবিআর। কিন্তু এই ই–পেমেন্টের পুরো প্রক্রিয়াকে ঢেলে না সাজানোর কারণে অনেক সময় আমরা সকালে ই–পেমেন্ট করেও তার কনফার্মেশন পাচ্ছি বিকেলের দিকে। এতে করে পণ্য খালাসও বিলম্বিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ–সভাপতি খায়রুল আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কাস্টমসের সকল অটোমেশন না হওয়ার কারণে স্টেকহোল্ডারদের পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। কাস্টমস গত ১ জানুয়ারি থেকে বাধ্যতামূলক থেকে ই–পেমেন্ট চালু করে। এটি নিঃসন্দেহে এটি ভালো খবর। কিন্তু সমস্যা হলো কাস্টমসের শুল্ক পরিশোধের একমাত্র ব্যাংক হলো সোনালী ব্যাংক। অন্যান্য অনেক ব্যাংকের সোনালী ব্যাংকের সার্ভারের কানেক্টিং না থাকার কারণে এর সুফলও ওই ভাবে মিলছে না। আরেকটি বিষয়টি হলো– আমরা ঘরে বসে অনলাইনে ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানিপেস্টো (আইজিএম) দাখিল করি। কিন্তু আমাদের আইজিএম অ্যামেন্ডমেন্ট (সংশোধনী) এর জন্য কাস্টম হাউসে ছোটাছুটি করতে হয়। আমরা অফিসে বসে বিএলের বিপরীতে আইজিএম দাখিল করতে পারি, কিন্তু সংশোধনীর জন্য কাস্টমস কর্তারা সকল অর্জিনাল কাগজপত্র চায় এবং অনেক ঘুষও চেয়ে বসেন। আমরা চাই, আইজিএমের সংশোধনীটাও অনলাইনে হয়ে যাক।
আমিন অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্ত্বাধিকারী এবং কাস্টমসের নিয়মিত বিডার ফজলুল আমিন বলেন, কাস্টমসে ই–অকশন চালু করা হলেও মূলত ই–অকশন হচ্ছে কেবল নামেই। একমাত্র দরপত্র জমা দেয়াটাই হচ্ছে অনলাইনে। বাকি সব প্রক্রিয়া সেই আগের মতোই ম্যানুয়ালি করতে হচ্ছে বিডারদের। এতে ভোগান্তি সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, কাস্টমসে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি। এই করোনাকালে এটি খুব বেশি প্রয়োজন। অটোমেশন হয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবে এটি সহজে বলা যায়। খাতুনগঞ্জের একজন ব্যবসায়ীকে কাস্টমসে দৌড়াদৌড়ি করতে হলে তার কিন্তু পুরো দিন শেষ। অটোমেশন হয়ে গেলে ব্যবসায়ীদের কাজ কমে যায়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, কাস্টমসের সকল কাজ অটোমেশনের করার জন্য এনবিআরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচেষ্ট রয়েছেন। আমরা পরীক্ষামূলক ই–পেমেন্ট চালু করার পর গত ১ জানুয়ারি থেকে বাধ্যতামূলক ই–পেমেন্ট চালু করেছি। এছাড়া গত ২০২০ সালের শেষ দিকে ই–অকশন (অনলাইন নিলাম) চালু করেছি। অনলাইন মাধ্যমে কাজ করতে গেলে সার্ভারের কিছু কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়।