করোনাকালে অপরাধ কর্মকাণ্ড থেমে নেই। এমনকি মাস্ক পরে অপরাধ কর্ম সম্পাদন করছে অপরাধীরা এখন অহরহ। গত ২৯ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তার উল্লেখ পাওয়া গেছে। ‘মাস্ক পরেই সক্রিয় অপরাধীরা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণঘাতী করোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে মাস্ক পরছেন সবাই। কিন্তু এটি পরে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তাদের চিহ্নিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। মাস্কের আড়ালে ঢাকা অপরাধীরা ঠিকই রয়ে যাচ্ছে নগরীর নির্জন রাস্তায়। আর সুযোগ বুঝে কেড়ে নিচ্ছে সব। এ ধরনের একাধিক ঘটনা ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন আজাদীকে। যারা থানায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ পুলিশের উল্টো জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে যে কেন তিনি বাড়ির বাইরে বের হয়েছেন।
সিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক মাস্ক পরে অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি স্বীকার করে আজাদীকে জানিয়েছেন, মাস্ক পরা থাকুক আর না থাকুক, অপরাধ করলে ধরা পড়তেই হবে। তিনি বলেন, আগে তো এখনকার মতো সিসি ক্যামেরা ছিল না। কিন্তু তখনও তো মামলা ডিটেক্ট হয়েছে। তবে বিভিন্ন বেশ ধারণ করলে অপরাধী শনাক্তে একটু সময় লাগে, এই আর কী। নগর জুড়ে সার্বক্ষণিক পুলিশ টহল রয়েছে। সন্দেহভাজনদের জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। আমাদের পুলিশ ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে।
বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে সামপ্রতিক সময়ে অপরাধীরা সম্পত্তি ও জানমাল সম্পর্কিত (চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি) অপরাধ সংঘটনের কৌশল পরিবর্তন করেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর এসেছে যে, পকেটমার, ছিনতাইকারী ও মলম-পার্টির সদস্যরা এখন মাস্ক পরে আবার কখনো মাস্ক বিক্রেতা সেজে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে অথবা বসতবাড়িতে ঢুকে স্বর্ণালঙ্কার-মোবাইলসেট, টিভিসেটসহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। শহরের অধিকাংশ মানুষ লকডাউনে গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ায় ডাকাতিও বেড়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ প্রসঙ্গে অপরাধবিজ্ঞানী কোহেন এবং ফেলসনের প্রদত্ত রুটিন এক্টিভিটি তত্ত্ব অনুসারে, একজন সুযোগপ্রাপ্ত অপরাধী তখনই অপরাধ করবে যখন তিনি দেখবেন উক্ত অপরাধ সংঘটনের স্থানে সুযোগ্য পাহারাদার নেই এবং অপরাধের লক্ষ্যবস্তু অরক্ষিত রয়েছে। লকডাউনের সময় রাস্তায় কম মানুষ থাকায় এবং শপিং মলসহ বিভিন্ন দোকান বন্ধ থাকায় অপরাধীরা এ পন্থা অবলম্বন করে ছিনতাই ও চুরির মত অপরাধ করতে পারে বলে ধারণা। এছাড়া সামপ্রতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের সরকার অপরাধীদের সাজা মওকুফ করে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে সমাজে পুনঃঅপরাধীর (রেসিডিভিস্ট) সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে অপরাধবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, লকডাউনের কারণে অনেক দিন ব্যবসা বাণিজ্যসহ দোকাট-পাট বন্ধ, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, মার্কেটসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ, সেহেতু এখানে ভিন্ন ধরনের অপরাধ যেমন চুরি, ডাকাতি, সিঁদেল চুরি সংখ্যা বাড়ছে। করোনার সময়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষজনের যেহেতু কাজের সুযোগ কমে গেছে এবং অনেকেই ইতিমধ্যে বেকার হয়েছেন। ফলে অর্থনৈতিক নিয়মেই এই বেকার শ্রেণির মধ্যে এই ধরনের সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে।
করোনা মহামারীর সময়ে বাংলাদেশে চুরি, ডাকাতিসহ সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধের হার বৃদ্ধি, খুন-হয়রানি, জঙ্গিহামলাসহ পেশাদার অপরাধের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা, দরিদ্র পরিবারগুলোতে সহিংসতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন ধরনের ঘৃণাজাত মোটিভ থেকে ঘৃণ্য অপরাধের হার বৃদ্ধি পেতে পারে, তাই এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের এখনই সচেতনার পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে সামগ্রিক ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। অপরাধবিজ্ঞানের জ্ঞান থেকে আমরা জানি যে, মানুষের অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা, কাজহীনতা এবং বেকারত্ব দীর্ঘমেয়াদে অপরাধ বৃদ্ধির সাথে সরাসরি যুক্ত। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে অপরাধ থেকে জড়িয়ে পড়া রোধ করতে সরকারকে অবিলম্বে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। তাদের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় এনে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে যাতে তারা অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা পায়।
সঠিক পরিকল্পনার অভাব আমাদের করোনাকালীন ও তার অব্যবহিত পরেই ‘সামাজিক স্বাস্থ্যে’র জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। মাস্ক পরে যাতে নগরীতে অপরাধ না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পুলিশের টহল ও ফুট পেট্রলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশকেও নানা কর্ম কৌশল অবলম্বন করতে হবে।