ক্ষমতার পালাবদলের পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে কর্মস্থলে অনুপস্থিত এবং দায়িত্ব পালন না করা পুলিশ সদস্যদের আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে অনুপস্থিতরা আর ‘চাকরি করতে চাইছেন না’ বলে ধরে নেওয়া হবে।
দায়িত্ব নিয়ে গতকাল রোববার প্রথমবার সচিবালয়ে আসা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমি আইজিপি সাহেবের সাথে আলাপ করেছি, র্যাবের ডিজির সাথে আলাপ করেছি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের সাথে আলাপ করেছি। আপনারা যদি বৃহস্পতিবার না আসেন আমরা ধরে নেব আপনারা চাকরিতে ইচ্ছুক নন। বৃহস্পতিবারের মধ্যে যে যার জায়গায় চলে যাবেন, ডিউটিতে থাকবেন। আর চাটুকারিতা করলে মিডিয়া বন্ধ করে দেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এছাড়া ট্রাফিকের কাজ করা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। খবর বিডিনিউজের।
গণআন্দোলন ও সহিংসতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য। নিরাপত্তাহীনতা ও সহকর্মীদের হতাহত হওয়ার ক্ষোভ থেকে ৫ আগস্টের পর কাজে যোগ দেননি পুলিশের নন ক্যাডার সদস্যরা। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়েও গেছেন। ফলে ঢাকার রাস্তাঘাট এবং থানাগুলো কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে।
নিরাপত্তাসহ ১১ দফা দাবিতে ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন নন ক্যাডার পুলিশ সদস্যরা। এ পরিস্থিতিতে পুলিশি ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। পুলিশহীন রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে নামানো হয় আনসার।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের সামনে বলেন, পুলিশের গায়ে যেন অহেতুক কেউ হাত না দেয়। ছোট, বড় অপরাধ যাই হোক, তাদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচারের আওতায় আনা হবে। ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। জনগণকে আমি এটুকু বলতে চাই, আপনারা পুলিশের গায়ে হাত দেবেন না। আপনারা দেখছেন, আপনারা নিজেরাই সাফার করছেন।
পুলিশ থানায় না থাকার ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে এক ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। রাত হলেই ঢাকার অলি–গলিতে সৃষ্টি হচ্ছে ডাকাত আতঙ্ক। দল বেঁধে পাড়া–মহল্লায় পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
এ প্রসঙ্গ টেনে সাখাওয়াত বলেন, রাতে রাতে আমার কাছে টেলিফোন আসে, অমুক জায়গায় ডাকাতি হয়েছে। আমি বললাম; আল্লাহ আল্লাহ করো আর কিছু করার নাই। যদি ডাকাতি হয়, সেখানে যদি পুলিশ না থাকে কী করবে?
গতকাল সকালে ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। তাতে ছয়জন আহত হন। সে বিষয়েও কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, চেষ্টা করছি যাতে পুলিশ ফিরে আসে, যদি না ফেরে, আপনারা দেখছেন কী হতে পারে। একটু আগে দেখলাম ব্যাংকে মারামারি হইছে, ব্যাংক দখল করবে। এখন মনে হয় যে যার মতো করে যা দখল করতে পারে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কিছুক্ষণ আগে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে আনসারের একটি অংশ। তাদেরও কিছু দাবিদাওয়া আছে। সবারই দাবিদাওয়া আছে, আমারও দাবিদাওয়া আছে। আমার দাবিদাওয়া হলো, আপনারা ফিরে যান; আমি আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে আমার দায়িত্ব আপনাদের কাছে আসা, আপনাদের কথা শোনা। এবং যতদূর সম্ভব আমার পক্ষে ইমিডিয়েট যা করার করব। প্রত্যেক বাহিনীর সঙ্গে আমি কথা বলব।
অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে তিনি বলেন, আমি আসলাম দখল করব, বাজার দখল করব, ঘাট দখল করব, চান্দাবাজি করব। কিছুদিন করেন, কিন্তু আমি সেনা প্রধানকে বলেছি, অনুরোধ করেছি; পা ভেঙে দিতে আপনাদের। আই ডোন্ট কেয়ার, ইউ গো টু হেল।
চাটুকারিতা হলে মিডিয়া বন্ধ : কোনো সংবাদমাধ্যম চাটুকারিতা করলে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। দুপুরে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, অন্তত এই পিরিয়ডে কোনো মিডিয়া চাটুকারিতা করবেন, মিডিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমি আবার বলি, চাটুকারি মিডিয়া হলে বন্ধ করে দিব।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সংবাদমাধ্যম যে ভূমিকা রেখেছে তার সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, অতীতে গণমাধ্যমে সত্য ঘটনা তুলে ধরা হয়নি। সেটি করা হলে আজ এই অবস্থা হতো না। আপনারা সত্যি ঘটনা তুলে ধরেন নাই। আপনারা যদি ওই সময় সত্যি ঘটনা তুলে ধরতেন যে কী হচ্ছে, তাহলে আজ পুলিশের এই অবস্থা হয় না। বারবার বলা হয়েছে ‘কিছু হয় নাই, কিছু হয় নাই’। বিবিসি থেকে আমি দেখছি, কিন্তু আমাদের মিডিয়া বলে না। শেইম অন ইউ। আই শেইম অন দ্য মিডিয়া ওনার্স।
টেলিভিশন টকশোতে ‘চাটুকারদের’ না ডাকার আহ্বানও জানান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। তার কথায়, টকশোতে তালিকা ধরে অতিথিদের ডাকা হয়। টকশোতে জ্ঞানগর্ভ কোনো আলোচনা হয় না। এদেশ মেধাশূন্য হয়ে গেছে। আপনারা এদেরকে ডাইকেন না। চাটুকারদের ডাকবেন না। চাটুকারি মিডিয়া হইয়েন না। দয়া করে আপানারা মিডিয়ায় সঠিক তথ্য তুলে ধরেন, যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের ওপর চোখটা যেন পড়ে। একটা দেশ তখনই ডোবে, যখন মিডিয়া সত্যি কথা বলে না।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি চাটুকারের রাজনীতিতে পরিণত করা হয়েছে। এতে দেশের ক্ষতি হয়েছে। আপনি রাজনীতিবিদ তৈরি করেননি, চাটুকার তৈরি করেছেন। এমন চাটুকার তৈরি করেছি যে, মানুষ মরে যাচ্ছে, কিন্তু তারা বলছে, না, সব ঠিক আছে। এমন চাটুকারের দল দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। যারা রাজনীতি করছেন, তারা তো রাজনীতি বাদ দিতে পারবেন না। চাটুকারিতা বাদ দেন।
সাখাওয়াত বলেন, মিডিয়ার সামনে গিয়ে চাটুকাররা আধা ঘণ্টা কথা বলেন। এখন কোথায় গেছেন উনারা? কে কোথায় পালিয়েছে, আত্মগোপন করে আছেন। কারণ, অ্যান্টি পিপল, আপনারা চাটুকারিতা করেছেন। আপনারা সঠিক পরামর্শ দেননি। আপনার হালুয়ারুটির খাওয়ার দরকার ছিল। চিন্তা করেন তাদের পিওন ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে যায়। আমি জীবনে ১ কোটি টাকার বেশি চিন্তা করতে পারি না।
ট্রাফিকের কাজ করা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে : সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে যেসব শিক্ষার্থী ট্রাফিকের কাজ করছে তাদের তালিকা করে সবাইকে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, এ সার্টিফিকেট তাদের চাকরির ক্ষেত্রে যেন মূল্যায়ন হয়।