চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) অবশেষে পুরোদমে চালু হচ্ছে। আগামী ৮ জুন থেকে এই টার্মিনালে কন্টেনার জাহাজ বার্থিং দিয়ে খালাস কার্যক্রম শুরু হবে। সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) বাংলাদেশ লিমিটেডকে এখানে জাহাজ বার্থিং থেকে শুরু করে আমদানি–রপ্তানি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার সাময়িক অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ৮টি শর্তে দেওয়া এই অনুমোদনপত্র গতকাল পাওয়ার পর আগামী শনিবার থেকে পিসিটিতে জাহাজ বার্থিং দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। প্রথম দিন এমভি মার্কস ডাবো জাহাজ বার্থিং দেওয়া হবে। শুরুতে শুধুমাত্র ক্রেন আছে এমন গিয়ার ভ্যাসেলই এখানে হ্যান্ডলিং করা হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, রপ্তানি ও বন্ড শাখার স্মারক (নং ০৮.০১.০০০০.৫৬.০৩.০০১.২০১৯/২২২) মূলে গতকাল জানানো হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে বোর্ড পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের অপারেশনাল কার্যক্রম চালু করার সাময়িক অনুমতি প্রদান করেছে। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নবনির্মিত পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেডের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তির আওতায় রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড উক্ত টার্মিনালে বার্থিং নেওয়া জাহাজ থেকে লোডিং, আনলোডিং, ট্রান্সপোর্টিং, হ্যান্ডলিং, ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট, কন্টেনার খালাস ও ডেলিভারি, শেড ও ওয়্যারহাউজ থেকে পণ্য স্টাফিং এবং আনস্টাফিংসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ আগামী ৬ জুন থেকে পিসিটিতে জাহাজের বার্থিং, আমদানি–রপ্তানি ও ডেলিভারি সংক্রান্ত অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এনবিআর ৬ জুন থেকে জাহাজ বার্থিংয়ের অনুমোদন দিলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ ৮ জুন থেকে জাহাজ বার্থিং দেওয়া শুরু করবে।
এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে সহায়তা, জাহাজ জট কমানো এবং পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত খরচ ও সময় কমানোর উদ্দেশ্যে কাস্টমস সংক্রান্ত যাবতীয় আইনী বাধ্যবাধকতা ও আনুষ্ঠানিকতা পালন করে শর্তসাপেক্ষে এই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এনবিআর এই টার্মিনালে কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আটটি শর্ত দিয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেডের অর্থায়নে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে এসাইকোডা কানেক্টিভিটি স্থাপনের জন্য যাবতীয় আইটি ইকুইপমেন্ট, এঙেসরিজ, কম্পিউটার, রাউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোস্ট্যাট মেশিন, ইন্টারনেট কানেকশনসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাপ্তরিক কার্যক্রম, এঙামিনেশন ও আনস্টাফিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষ, যানবাহন ও নিরাপত্তা সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সকল লজিস্টিকস অপারেশনাল কার্যক্রম শুরুর আগেই নিশ্চিত করতে হবে।
বন্দরে অবতরণীয় পণ্য চালানের বিল অফ ল্যাডিংয়ের (বিএল) কন্টেনার সেগমেন্টে পিসিটির জন্য বরাদ্দকৃত কন্টেনার লোকেশন কোড ব্যবহার করতে হবে। অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়ান স্টপ সলিউশন সেন্টারের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থার ন্যায় বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল হতে পণ্য খালাসকালে এঙিট নোট ইস্যু করতে হবে। শুল্ক–কর পরিশোধ ও কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পণ্য চালান পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল থেকে সাউথ কন্টেনার ইয়ার্ডে প্রেরণ করা যাবে না। পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে স্ক্যানার স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন অফডক ও ইপিজেডে গমনকারী কন্টেনারসমূহ কায়িক পরীক্ষণ সাপেক্ষে নিশ্চিত হয়ে প্রেরণ করতে হবে।
পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল হতে খালাসতব্য এলসিএল কার্গো বোঝাই কন্টেনারসমূহ শতভাগ কায়িক পরীক্ষণ করতে হবে এবং এফসিএল কার্গো বোঝাই কন্টেনারসমূহ কাস্টমস ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় নির্ধারিত পদ্ধতিতে কায়িক পরীক্ষণ করতে হবে। পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে আগত সকল পণ্য চালানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় কায়িক পরীক্ষণ প্রযোজ্য হবে এবং সে অনুযায়ী রেড সী গেটওয়েকে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রাইভেট পোর্ট অপারেটরদের বিষয়ে নীতিমালা বা বিধিমালা চূড়ান্ত হলে তার আওতায় আরএসজিটি বাংলাদেশ লিমিটেডকে অবিলম্বে লাইসেন্স বা অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের পাশ থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত আগেকার বিমানবন্দর সড়কের বাঁকগুলো সোজা করে উদ্ধার করা নদীপাড়ের ৩২ একর জায়গায় পিসিটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ই–ইঞ্জিনিয়ারিং এটির নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি নির্মাণকাজ শেষ হলেও নানা কারণে চালু হয়নি। অবশেষে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে লিমিটেডের সাথে গত ডিসেম্বরে চুক্তি সম্পাদনের পর তাদেরকে এই টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পিসিটিতে চট্টগ্রাম বন্দরের এযাবতকালের সবচেয়ে ‘বড়’ জাহাজগুলোকে অনায়াসে বার্থিং দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাড়তি গভীরতার পাশাপাশি চ্যানেলে কোনো বাঁক না থাকায় পিসিটি বড় জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধা পাবে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে এনসিটি, সিসিটির দূরত্ব ১৪–১৫ কিলোমিটার। আর পিসিটির দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। এটা বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালগুলোর তুলনায় পিসিটিকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে।
এই টার্মিনালে বছরে প্রায় ৫ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। টার্মিনালটিতে ১৬ একর ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন পশ্চাৎসুবিধা এবং ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ জেটি রয়েছে। জেটি এলাকায় পানির গভীরতা সাড়ে ১১ মিটার হলেও ১০ থেকে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যাবে। এই টার্মিনালে ১৯০ মিটার লম্বা ও ১০ বা সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের ৩টি কন্টেনার জাহাজ একসাথে এবং ২২০ মিটার দীর্ঘ ডলফিন জেটিতে ১টি ভোজ্যতেলবাহী জাহাজ ভিড়ানো যাবে। তবে ২১০ মিটার বা বেশি ল্যান্থের জাহাজ ২টির বেশি ভিড়ানো যাবে না। টার্মিনালে ১ লাখ ১২ হাজার বর্গমিটারের আরসিসি পেভমেন্ট (অভ্যন্তরীণ ইয়ার্ড ও সড়ক), ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার কন্টেনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) শেড, ৬ মিটার উঁচু ১ হাজার ৭৫০ মিটার কাস্টমস বন্ডেড ওয়াল, ৫ হাজার ৫৮০ বর্গফুটের পোর্ট অফিস ভবন, ১ হাজার ২০০ বর্গমিটারের যান্ত্রিক ও মেরামত কারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে টার্মিনালকে একটি স্বতন্ত্র বন্দরের আদল দেওয়া হয়েছে।
টার্মিনালটি পরিচালনায় রেড সী গেটওয়ে বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করেছে। তবে কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের মতো বড় ইকুইপমেন্ট আনতে আরো সময় লাগবে। কী গ্যান্ট্রি ক্রেন না থাকায় শুরুতে এই টার্মিনালে শুধুমাত্র গিয়ারড ভ্যাসেল (যে জাহাজের নিজস্ব ক্রেন আছে) হ্যান্ডলিং করা হবে। টার্মিনালটি পুরোদমে চালু করতে ৪টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি), ৮টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি (আরটিজি), ৪টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, ৪টি রিচ স্ট্যাকার, ১টি রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরএমজি), ৪টি লো–মাস্ট ফর্ক লিফট, ২টি ফায়ার ট্রাক, ১টি ফায়ার কার, ৩টি নিরাপত্তা পেট্রোল কার, ১টি অ্যাম্বুলেন্স, ৫০ টনের দুটি টাগ বোট, ২টি পাইলট বোট, ২টি ফার্স্ট স্পিড বোটসহ অন্তত ৮শ কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট লাগবে। চুক্তি অনুযায়ী পিসিটির প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট বিদেশি অপারেটর ক্রয় করবে। তারা দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২২ বছর এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এরপর ইকুইপমেন্টসহ বন্দরটি যেভাবে থাকে তা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, আগামী ৮ জুন থেকে পিসিটি চালু হবে। রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে।