ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রস্তাবে গাজা দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভা যুদ্ধ শেষ করার জন্য পাঁচটি নীতিও গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নয় এমন একটি বিকল্প বেসামরিক সরকার গঠন করা। বৈঠকে বিতর্কিত এই পরিকল্পনা নিয়ে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা হয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী প্রধান এবং নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে। নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপ ইসরায়েলেও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। হামাসের হাতে জিম্মিদের পরিবারগুলোও বলছে, এর ফলে জিম্মিদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। আরও বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত ও বাস্তুচ্যুত হবে। এদিকে গাজা সিটি দখলের ইসরায়েলের পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন দেশের নেতারা এই পদক্ষেপকে বিপজ্জনক, বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন এবং তা বিপর্যয়কর মানবিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন। খবর বিবিসি বাংলা ও বিডিনিউজের।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় গাজা শহর দখলের অনুমোদিত পরিকল্পনা এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য পাঁচটি নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যা মন্ত্রিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে বেসামরিক জনগণকে মানবিক সহায়তা প্রদানের সময় আইডিএফ গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে, এতে বলা হয়েছে। যুদ্ধ শেষ করার জন্য যে নীতিগুলো নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে– ১. হামাসের নিরস্ত্রীকরণ। ২. জীবিত ও মৃত উভয় ধরনের জিম্মিকে ফেরানো। ৩. গাজা উপত্যকার নিরস্ত্রীকরণ। ৪. গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলি নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ। ৫. হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নয় এমন একটি বিকল্প বেসামরিক সরকার গঠন। মন্ত্রিসভার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা বিশ্বাস করেছিলেন যে মন্ত্রিসভার কাছে উপস্থাপিত বিকল্প পরিকল্পনা হামাসের পরাজয় বা অপহৃতদের ফিরিয়ে আনতে পারবে না, বিবৃতির উপসংহারে বলা হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সম্প্রসারণের বিষয়ে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা নিয়ে এর আগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। এটি লাখ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য বিপর্যয়কর পরিণতির ঝুঁকি তৈরি করবে এবং গাজার অবশিষ্ট জিম্মিদের জীবনকে আরও বিপন্ন করতে পারে, মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক সভায় বলেছিলেন সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকা।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই গাজা উপত্যকার বিশাল অংশের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ রাখার দাবি করে আসছে। জাতিসংঘের অনুমান, গাজার ৮৭ শতাংশ এলাকাই হয় স্বীকৃত সামরিক নিয়ন্ত্রণে অথবা উচ্ছেদের নোটিশের আওতায় আছে। গত মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েল পুরো উপত্যকাকে ‘বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ ঘোষণা করে যা পরবর্তী মাসগুলিতে ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার জন্য উচ্ছেদের নোটিশও জারি করে, যদিও কখন এগুলো প্রত্যাহার করা হয় তা সবসময় স্পষ্ট করা হয় না।
নিজের প্রস্তাবগুলো নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, ফক্স নিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দেন নেতানিয়াহু। যেখানে বিস্তারিত কিছু না বললেও ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। এছাড়া হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বেসামরিক শাসন অন্য দলের কাছে হস্তান্তর করতে চান বলেও জানান তিনি। তবে তিনি এটাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই অঞ্চলটি ধরে রাখার ইচ্ছা নেই তার। নেতানিয়াহু বলেছেন, আমরা এটি পরিচালনা করতে চাই না। আমরা সেখানে একটি শাসকগোষ্ঠী হিসেবে থাকতে চাই না। আমরা এটি আরব বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে চাই।
কী ব্যবস্থাপনা করা হবে বা কোন দেশগুলো এখানে জড়িত থাকতে পারে সে সম্পর্কে অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলেননি নেতানিয়াহু। তবুও যুদ্ধ–পরবর্তী গাজার জন্য তিনি কী কল্পনা করছেন এটি তারই একটি ইঙ্গিত। আপাতত নেতানিয়াহু একটি বিস্তৃত আক্রমণ চালাতে চান যার মাধ্যমে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার কেন্দ্রীয় অংশের শিবিরগুলোতে অভিযান চালাতে পারে যেখানে প্রায় দশ লাখের মতো ফিলিস্তিনি বসবাস করে।
বর্তমানে গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে বলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে। সম্ভাব্য এই অভিযান যা কয়েক মাস ধরে চলতে পারে, এর অর্থ হবে ব্যাপকভাবে মানুষের বাস্তুচ্যুতি। এছাড়া এর মাধ্যমে সেখানে মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
ইসরায়েলি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উদ্বেগ দেখা যায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির নেতানিয়াহুকে এক বৈঠকে বলেন যে গাজার সম্পূর্ণ দখল সেনাদের জন্য ফাঁদে পা দেওয়ার সমান। ইসরায়েলের সেনাপ্রধান তার দেশের সরকারকে সতর্ক করেছেন বলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, এই আক্রমণ হামাসের কাছে এখনো জিম্মি ২০ জন, যাদেরকে জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে, তাদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে।
অনেক জিম্মি পরিবারও এই পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো হামাসের সাথে আলোচনা। মারিভ সংবাদপত্রের মতে, প্রচলিত মূল্যায়ন হলো বেশিরভাগ এবং সম্ভবত জীবিত জিম্মিরা মৃত্যুবরণ করবে। হয় জিম্মিকারীরা তাদের তাদের হত্যা করবে অথবা দুর্ঘটনাক্রমে ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা তাদের মৃত্যু হবে।
ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ও নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বাকবিতণ্ডা : বিতর্কিত গাজা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা হয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী প্রধান এবং নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে একথা জানানো হয়েছে। ইয়ানেট সংবাদ ওয়েবসাইট জানিয়েছে, ১০ ঘণ্টা দীর্ঘ বৈঠকে সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তার মতে, এটি কার্যত দখলদারিত্বই বোঝায়। এতে যেসব এলাকা দখলে আনা হবে সেসব জায়গায় বাস করা প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হতে পারে। ২০ জন ইসরায়েলি বন্দির জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। যারা এখনও জীবিত আছে বলে ধারণা করা হয়।
সেনাপ্রধান জামির আরও বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে ক্লান্ত সেনাবাহিনীর ওপর এতে অতিরিক্ত চাপ পড়বে। গাজার বিভিন্ন অভিযানে অনেক রিজার্ভ সেনা সদস্য ইতোমধ্যেই একাধিকবার অংশ নিয়েছেন।
বিবিসি লিখেছে, কবে থেকে এই দীর্ঘমেয়াদি অভিযান শুরু হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এতে হাজার হাজার সেনা সদস্য মোতায়েন করতে হবে ইসরায়েলকে। আবার গাজার বেসামরিক নাগরিকদেরকেও আবার সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে হবে, যাদের অনেকেই এর আগে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, অভিযানের বিস্তার ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আরও বেশি প্রাণহানির ঝুঁকি তৈরি করবে।
বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় : গাজা সিটি দখলের ইসরায়েলের পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোনে জানান, ফিলিস্তিনিদেরকে নিজভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করার যে কোনও প্রচেষ্টার তিনি স্পষ্টতই বিরোধিতা করেন।
জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার কঠোর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সেই নীতিরই আরও সমপ্রসারণ যেখানে ক্ষুধা ও অবরোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং হাসপাতাল ও স্কুলসহ বেসামরিক অবকাঠামোকে ধারাবাহিকভাবে টার্গেট করা হয়।